বর্তমানে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে। যেখানে ইরান, রাশিয়া এবং চীনের মধ্যে কৌশলগত সহযোগিতার সম্পর্ক একটি নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা পেয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্য সব সময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান, রাশিয়া এবং চীনের মধ্যে গড়ে ওঠা কৌশলগত মিত্রতা একদিকে যেমন শক্তিশালী জোট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, অন্যদিকে এটি যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের জন্য নতুন ও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। একসময়ের বিচ্ছিন্ন এবং ভিন্ন স্বার্থের দেশগুলো এখন নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা বাড়িয়ে তুলেছে, যা কেবল তাদের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকে মজবুত করছে না, বরং যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছএ আধিপত্যকেও চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
এই জোট শুধু সামরিক শক্তিতে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে একটি পূর্ণাঙ্গ সমন্বয় গড়ে তোলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইরান-রাশিয়া-চীনের মধ্যে গড়ে ওঠা এই জোটে সামরিক সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি বিনিময়, বাণিজ্যিক সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক মঞ্চে একযোগে কাজ করার প্রবণতা দৃশ্যমান। এমন বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যা বৈশ্বিক রাজনৈতিক অঙ্গনে এক নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে। এই তিনটি দেশের ঐক্য বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাবের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্যে। যা বিশ্ব রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক বলয়ে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
ত্রিশক্তির ইতিহাস ও পটভূমি:
১৯৭৯ সালের “ইসলামিক বিপ্লব” ইরান এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্কের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। ইরানের ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান শুধু দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পরিবর্তন ঘটায়নি, বরং বৈশ্বিক শক্তি ভারসাম্যেও বড় পরিবর্তন আনে। পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ক্রমশ দূরত্ব বাড়তে থাকে ইরানের। যা ধীরে ধীরে রাশিয়া ও চীনের দিকে দেশটিকে আরো ঝুঁকতে বাধ্য করে। ইরান-রাশিয়া – চীন এই তিন দেশের সম্পর্ক মূলত অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। ২০০০ সালের পর থেকে এই ঘনিষ্ঠতা নতুন রূপ পেতে থাকে। বিশেষত যখন ২০১৪ সালে রাশিয়া – ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চলকে নিজেদের সাথে যুক্ত করে নেয় এবং ফলস্বরূপ পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার উপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই সংকট রাশিয়াকে পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। যা রাশিয়াকে ইরান ও চীনের সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে উদ্বুদ্ধ করে। ইরানও একইভাবে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও অর্থনৈতিক বাধার সম্মুখীন হওয়ায় এই সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করে।
বর্তমানে এই তিনটি দেশ বিভিন্ন সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। সাম্প্রতিক সময়ে তারা একাধিক সামরিক মহড়া ও কৌশলগত চুক্তি সম্পাদন করেছে, যা নতুন ধরনের জোটবদ্ধতার ইঙ্গিত দেয়। চীন তার “বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ” – এর মাধ্যমে মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট। যেখানে রাশিয়াও নিজেদের ঐতিহাসিক অবস্থান ধরে রাখতে আগ্রহী। ইরান এই দুই দেশের সাথে সম্পর্ক শক্তিশালী করে কেবল নিজেদের অর্থনৈতিক সংকট দূর করতেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করতেও কাজ করছে।
বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে, এই তিন দেশের মিত্রতা শীতল যুদ্ধের সময়ের নতুন মঞ্চ হিসেবে দেখা যেতে পারে। তারা পশ্চিমা দেশগুলোর একচেটিয়া প্রভাব মোকাবিলার কৌশল হিসেবে নিজেদের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। তবে এই সহযোগিতার ফলাফল ভবিষ্যতের বৈশ্বিক রাজনীতির জন্য কতটা স্থায়ী হবে, তা বলা কঠিন। কিন্তু একটা বিষয় স্পষ্ট— তাহলো বিশ্ব রাজনীতির ভারসাম্য বজায় রাখতে ইরান, রাশিয়া এবং চীনের জোট একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ইরান ও চীনের মধ্যকার কৌশলগত সম্পর্ক দিন দিন গভীর হচ্ছে, যা শুধু অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বে আটকে নেই বরং ভূ- রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে। ২০২১ সালে করা কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তিটি ইরানের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ চীন এখন ইরানের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে এক প্রধান মিত্র ও সমর্থক। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার চাপ অগ্রাহ্য করে ইরান এখন অধিকাংশ জ্বালানি তেল চীনেই রপ্তানি করছে। ২০২৩ সালে ইরানের তেল রপ্তানির ৯০ শতাংশই গিয়েছে চীনে। এই পরিসংখ্যান বোঝাচ্ছে, ইরান-চীন অর্থনৈতিক সম্পর্ক কতটা শক্তিশালী এবং পারস্পরিক নির্ভরশীল।
এমন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে “ইরান-চীন এনার্জি স্যাংশন অ্যাক্ট” পাস করেছে, যেখানে ইরান থেকে তেল আমদানিকারক চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এমন একটি কৌশল যা ইরান-চীন সম্পর্ককে আঘাত করতে চায়। তবে এই নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। ইরান-চীন কেবল অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য একসঙ্গে জোট বদ্ধ নয়, বরং ভূ- রাজনৈতিক স্বার্থেও তারা একে অপরের সহযোগী।
বর্তমান বিশ্বে দেখা যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক ইস্যুগুলোতে ইরান, চীন এবং এমনকি রাশিয়াও প্রায়শই একসুরে কথা বলছে। বৈশ্বিক পরাশক্তির প্রভাব থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে এবং নিজ নিজ আঞ্চলিক প্রভাব ধরে রাখতে এই দেশগুলো একে অপরকে সমর্থন করে যাচ্ছে। এতে বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তনের ইঙ্গিত স্পষ্ট বলে প্রমাণিত হয়। যেখানে চীন ও ইরান নিজেদের ভবিষ্যৎ আরও কৌশলী ও শক্তিশালী করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য এই সহযোগিতা এক প্রকার চ্যালেঞ্জ। কেননা ইরানকে সরাসরি বাধা দিতে না পারলেও, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে ইরান-চীন সম্পর্ককে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে এই নিষেধাজ্ঞাগুলো আসলেই কতটা কার্যকর হবে? নাকি ইরান-চীন জোট আরও দৃঢ় হবে এবং বিশ্বে এক নতুন শক্তি ভারসাম্যের জন্ম দিবে। এই পরিস্থিতি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, মার্কিন প্রভাবকে হ্রাস করতে নতুন শক্তির উত্থান ঘটেছে। যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক নতুন যুগের সূচনা হতে পারে। ইরান-চীন সম্পর্ক তাই শুধু দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি বৃহত্তর এক শক্তি ভারসাম্যের অংশ, যা বিশ্বের ভবিষ্যত ভূ- রাজনৈতিক কাঠামোকে প্রভাবিত করবে।
সামরিক সহযোগিতা:
যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে যতটা বিচ্ছিন্ন করতে চাচ্ছে , অপরদিকে চীন ও রাশিয়া ততটাই তাদের মিত্র হিসেবে ইরানকে পাশে টেনে নিচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতে ইরান ধীরে ধীরে পশ্চিমা প্রভাবের বিকল্প শক্তির জোটগুলোর সদস্যপদ লাভ করছে, যা ইরানের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে। গত বছর চীন নেতৃত্বাধীন “সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন” (এসসিও) এ ইরান স্থায়ী সদস্যপদ লাভ করেছে। যা এ অঞ্চলে ইরানের প্রভাব বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি ইরান এবার ” ব্রিকস জোটে” ও যোগ দিয়েছে। যেখানে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক আরো মজবুত করেছে। “এসসিও ও ব্রিকস” এই দুই জোটকে চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা একটি বিকল্প শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, যা পশ্চিমা প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম। এমন এক সময়ে ইরানের এই দুই জোটে অংশগ্রহণ- যা যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যের কৌশলকে কার্যতঃ দুর্বল করে দিচ্ছে।
সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও এই জোটের প্রভাব স্পষ্ট। ২০১৯ সালে চীন, রাশিয়া এবং ইরান প্রথমবারের মতো যৌথ সামরিক মহড়া চালায়। এই বছরও মার্চে চতুর্থবারের মতো ভারত মহাসাগরের উত্তরাঞ্চল ও ওমান উপসাগরে চার দিনের নৌ বাহিনীর মহড়ায় অংশ নিয়েছে এই তিন দেশ। মহড়াটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যখন মধ্যপ্রাচ্যে লোহিত সাগরে হুতি আক্রমণ এবং হামাস-ইসরায়েল সংঘাতের কারণে পশ্চিমা নৌশক্তির বিপুল উপস্থিতি রয়েছে। তথ্য মতে- ইরানের নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল মুস্তাফা তাজ আলদিন এই মহড়া সম্পর্কে ব্যাখ্যা করে বলেন – এই মহড়া প্রমাণ করে যে, ভারত মহাসাগরের উত্তরাঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নতুন এক জোটের উত্থান ঘটেছে।
এই পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় ইরান-রাশিয়া-চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্রতা কেবল সামরিক মহড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি ভবিষ্যতে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া এবং বিশ্বের আরও কয়েকটি অঞ্চলে পশ্চিমা প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করে এই বিকল্প জোট দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি অবশ্যই একটি কৌশলগত চ্যালেঞ্জ । কারণ বিশ্ব অর্থনৈতিক ও সামরিক রাজনীতিতে নতুন ধরনের ভারসাম্য গড়ে উঠেছে। ইরানের জোটে যুক্ত হওয়া এবং সামরিক সহযোগিতার এই উদাহরণ বিশ্বব্যাপী এক নতুন ক্ষমতার মেরুকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বিশ্ব রাজনীতিতে ইরান, রাশিয়া এবং চীনের কৌশলগত সম্পর্ক এখন নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।আন্তর্জাতিক ফোরামে এই তিন দেশ একত্রে কাজ করছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে মোকাবিলায় তাদের আরও শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে তারা যুক্তরাষ্ট্রের নীতির বিরোধিতায় একযোগে প্রতিবাদ জানাচ্ছে, যা তাদেরকে কূটনৈতিকভাবে একটি শক্তিশালী জোটে পরিণত করেছে। এই সমন্বিত পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া আন্তর্জাতিক প্রভাবকে হ্রাস করেছে এবং বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO-World Health Organisation) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতেও তাদের সহযোগিতা লক্ষ্যণীয়। কোভিড – ১৯ মহামারির সময় একে অপরকে সহায়তা করার মাধ্যমে তারা কৌশলগতভাবে নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। মহামারির সময়ে চিকিৎসা সরঞ্জাম, তথ্য বিনিময় এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তায় একত্রে কাজ করে তারা নিজেদের কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করেছে। এই সহযোগিতার ফলে তারা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আরও শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা পশ্চিমা দেশগুলোর কৌশলগত পরিকল্পনার জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ । কূটনৈতিকভাবে এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে ইরান, রাশিয়া এবং চীন আন্তর্জাতিক স্তরে এক নতুন ধরনের প্রভাব বলয় তৈরি করেছে। যা যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের সামনে বিকল্প হিসেবে দেখা যাচ্ছে। তাদের এই সমন্বিত প্রচেষ্টা শুধু তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যই নয়, বরং একটি ন্যায্য ও বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যেও কাজ করছে। বিশ্ব রাজনীতিতে এ ধরনের মেরুকরণ ভবিষ্যতে শক্তির ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে মার্কিন বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন যে চীন, রাশিয়া এবং ইরানের সমন্বয়ে একটি নতুন যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী অক্ষশক্তি গড়ে উঠেছে। এই ত্রিদেশীয় সহযোগিতাকে বিভিন্নভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কেউ এটিকে – “অ্যাক্সিস অব ইভিল টু ” অর্থাৎ “শয়তানের অক্ষশক্তি নম্বর ২ “- হিসেবে বর্ণনা পাকানোর অক্ষশক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন । এছাড়াও, কয়েকজন গবেষক “অ্যাক্সিস অব অটোক্র্যাসি বা স্বৈরতন্ত্রের অক্ষশক্তি ” নামকরণ করেছেন, যা তাদের মতে- এই তিন দেশের মধ্যে গড়ে উঠা সম্পর্ক গণতন্ত্রবিরোধী এবং স্বৈরাচারী শাসনের দিকে ইঙ্গিত করে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া:
বিশ্ব রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইরান, রাশিয়া এবং চীনের মধ্যে গড়ে উঠা সহযোগিতা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই তিনটি দেশের ঐক্যের ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের প্রভাব বাড়ছে, যা মার্কিন নীতির প্রতি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। যুক্তরাষ্ট্র এই সম্পর্ককে দুর্বল করার জন্য বিভিন্ন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও কূটনৈতিক চাপের কৌশল গ্রহণ করেছে। বিশেষতঃ ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। যার ফলে ইরানের অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ইরান চীনের সঙ্গে তার শক্তিশালী বাণিজ্যিক সম্পর্কের মাধ্যমে এই চাপ মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছে। চীনের প্রতি ইরানের বাণিজ্যিক নির্ভরতা তাদের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা করেছে যা যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনাকে ব্যাহত করেছে।
এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো যেমন: ইরান- ইসরাইল আক্রমণ আবার পাল্টা আক্রমণ, রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ককে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে নেয়া হয়েছে। কিন্তু এই সব পদক্ষেপের পরও ইরান, রাশিয়া ও চীনের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক অব্যাহত রয়েছে। সামরিক, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক ক্ষেত্রে তারা একে অপরকে সমর্থন করছে, যা পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী জোট হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে, যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগুলো যদি সফল না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এই তিন দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও মজবুত হবে, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি নতুন গতিশীলতা আনতে পারে। ফলে, বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এই তিন দেশের সহযোগিতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
ইরান, রাশিয়া এবং চীনের ঐক্য একটি নতুন ভূ- রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করেছে। যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই তিনটি দেশের মধ্যে গঠিত সামরিক, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। ভবিষ্যতে এই সম্পর্কের বিবর্তন এবং এর প্রভাব বিশ্ব রাজনীতির অঙ্গনে গভীর প্রভাব ফেলবে।