দক্ষিণ এশিয়া একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চল, যেখানে ভারত এবং চীন দুটি বৃহৎ শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। ইতিহাস এবং আধুনিক যুগে, এই দুটি দেশ তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামরিক শক্তি এবং কূটনৈতিক ক্ষমতার মাধ্যমে শুধু দক্ষিণ এশিয়ার নয় বরং বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে ভারত ও চীনের মধ্যে সম্পর্কের চিত্র একেবারেই সহজ নয়- এখানে রয়েছে দ্বন্দ্ব, প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং সহযোগিতার সম্ভব।
চীন ও ভারতের গতি প্রকৃতি: অর্থনীতি, সামরিক শক্তি এবং কূটনীতি
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং প্রতিযোগিতা-
চীন এবং ভারতের অর্থনৈতিক গতি প্রকৃতির মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে, তবে এই দুই দেশেরই দ্রুত প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যণীয়। চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। যা গত কয়েক দশকে একে অপরকে ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। চীনের অর্থনীতি প্রধানত শিল্পভিত্তিক এবং বৈদেশিক বাণিজ্যেও এটি অত্যন্ত শক্তিশালী। ১৯৮০-এর দশক থেকে, চীনের দারুণ অর্থনৈতিক উত্থান বিশ্বজুড়ে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে: “চীনা রপ্তানি এবং উৎপাদন” এর মাধ্যমে।
অন্যদিকে, ভারত পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। তবে এর অর্থনৈতিক কাঠামো চীনের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। ভারতের অর্থনীতি প্রধানত সেবা খাতের উপর নির্ভরশীল- এটি তথ্যপ্রযুক্তি, ফিনান্স এবং অন্যান্য সেবার মাধ্যমে বিশ্ব বাজারে প্রবেশ করেছে। ভারতের প্রবৃদ্ধি প্রক্রিয়া চীনের মতো প্রাথমিকভাবে রপ্তানি ও নির্মাণের উপর নির্ভরশীল নয় বরং এটি তার অভ্যন্তরীণ বাজার এবং জনসংখ্যার ব্যাপকতা থেকে সুবিধা পায়।
সামরিক শক্তি: প্রতিযোগিতা এবং সংঘর্ষের আশঙ্কা-
চীন এবং ভারত উভয়েই শক্তিশালী সামরিক শক্তি হিসেবে পরিচিত। চীন বিশ্বে বৃহত্তম সেনাবাহিনী এবং অত্যাধুনিক সেনা প্রযুক্তি নিয়ে একনিষ্ঠ ভাবে সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে কাজ করছে। চীনের ‘অ্যাক্টিভ ডিফেন্স’ নীতি এবং রণনৈতিক শক্তি তৈরি তার সামরিক কৌশলগুলোর মধ্যে অন্যতম। চীন, সিঙ্গাপুর, পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক তৈরি করে তার সামরিক সক্ষমতা জোরদার করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ভারত সীমান্তে বিভিন্ন প্রকল্প এবং সামরিক আধুনিকীকরণের মাধ্যমে তার সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করেছে।
ভারতও তার সামরিক শক্তি উন্নত করেছে এবং একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী গড়ে তুলেছে। তবে ভারত চীনকে সামরিক দিক থেকে টেক্কা দিতে পারেনি। তবুও ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ এবং সংঘর্ষের আশঙ্কা কোনোভাবেই কমেনি। ২০২০ সালে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় দুই দেশের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ এবং সামরিক উত্তেজনা তা আরও বাড়িয়েছে।
কূটনৈতিক সম্পর্ক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি-
চীন ও ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক একেবারে জটিল ও অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। উভয় দেশ তাদের নিজস্ব অবস্থান বজায় রেখে আন্তর্জাতিক ফোরামে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকে। চীনের এক এলাকা, এক পথ (Belt and Road Initiative- BRI) এবং ভারতের এস্তার্ন পিভট কৌশল দক্ষিণ এশিয়াতে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। ভারত চীনের BRI প্রকল্পে অংশ নিতে অনীহা প্রকাশ করে। কারণ এটি ভারতের আঞ্চলিক সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হতে পারে, বিশেষত: পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের কারণে।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে চীন-ভারতের প্রভাব-
দক্ষিণ এশিয়া একটি শক্তিশালী ভূ-রাজনৈতিক এলাকা- যেখানে চীন ও ভারতের প্রভাব বাড়ছে। এই অঞ্চলে আফগানিস্তান থেকে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ- প্রত্যেক দেশই চীন ও ভারতের সাথে বিভিন্ন ধরনের কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক সম্পর্ক স্থাপন করছে। এই দ্বিপাক্ষিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রভাব দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক অঙ্গনে সরাসরি প্রতিফলিত হচ্ছে।
ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্য এবং চীনের ভূমিকা-
ভারত দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায় আধিপত্য বজায় রেখেছে। ভারতীয় নেতৃত্ব চায় দক্ষিণ এশিয়া তার নেতৃত্বাধীন একটি শক্তিশালী অঞ্চল হিসেবে পরিচিত হোক। তবে চীন এই আধিপত্যে চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষত পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ এবং বাংলাদেশের মধ্যে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে চীন দেশগুলোতে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে এবং বৃহত্তর অর্থনৈতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠা করছে।
চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC) এর মাধ্যমে পাকিস্তানে ব্যাপক চীনা বিনিয়োগ ভারতকে উদ্বিগ্ন করেছে। ভারত চীনের এই প্রভাব বৃদ্ধির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে থাকে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রতিযোগিতায় নিজেকে শক্তিশালী করতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে কাজ করছে।
ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা এবং তিস্তা নদীর পানি বিরোধ-
চীন এবং ভারত শুধু অর্থনীতি এবং সামরিক ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে না বরং দক্ষিণ এশিয়ার নদী ব্যবস্থাপনা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। চীন ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপর একাধিকার দাবি করে এবং এর পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করছে। এতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য উদ্বেগ তৈরি হয়েছে- কারণ ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলোর মধ্যে একটি। ভারত এই ব্যাপারে চীনের নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় জলসম্পদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে যৌথ সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।
শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে চীনের প্রভাব-
শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে চীনের ব্যাপক প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষত: অবকাঠামো উন্নয়নে চীনা বিনিয়োগের মাধ্যমে। ভারতের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ এ দুটি দেশ ঐতিহাসিকভাবে ভারতের আশপাশের প্রতিবেশী, ভারতের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাববলয়ের মধ্যে ছিল। চীনের প্রভাব বৃদ্ধির ফলে ভারত এই অঞ্চলে তার আধিপত্য হারানোর আশঙ্কা করছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নতুন অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।
চীন-ভারত সম্পর্ক: স্নায়ুযুদ্ধ ও সমাধানের পথ-
চীন ও ভারতের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব এবং কূটনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে রয়েছে তবে কিছু ক্ষেত্রে সহযোগিতার সম্ভাবনা রয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধের মতো উত্তেজনা বাড়লেও উভয় দেশই আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য ও একে-অপরের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে উন্নীত করতে আগ্রহী। ভারত-চীন উভয়ই নিজেদের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ এড়াতে চাইছে ও সেকারণেই তারা বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক আলোচনা এবং সীমান্ত ব্যবস্থাপনা কৌশল তৈরি করেছে।
যৌথ চেষ্টার মাধ্যমে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা-
চীন ও ভারতের মধ্যে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা আনতে একটি দীর্ঘমেয়াদী কৌশল প্রয়োজন। এই দুই দেশ নিজেদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কট এবং সীমান্ত বিরোধ নিরসনে সমঝোতা করতে পারে। এক্ষেত্রে, আন্তর্জাতিক ফোরাম যেমন জাতিসংঘ ও শাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (SCO) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
চীন-ভারত দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে শুধু নিজেদের দেশের সীমান্তের মধ্যে নয় বরং আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতেও এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দুটি দেশের গতি প্রকৃতি, অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, সামরিক শক্তি এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক আগামী দিনে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে, উভয় দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা, সীমান্ত সংঘর্ষ এবং আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারসহ নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য তাদের মধ্যে সহযোগিতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করার বিকল্প নেই।