২০২৩ সালের মে মাসে মণিপুরের মেইতেই ও কুকি জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে সহিংসতা শুরু হয়েছিল। তা গত বেশ কয়েকমাস ধরে এক রকম বন্ধই ছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের গোড়া থেকে আবারও সহিংসতা শুরু হয়। সাম্প্রতিক সময়ে এখানে বেশ কিছু হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি ভারতের ইতিহাসে প্রথমবার ড্রোন থেকে বোমা নিক্ষেপের ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়াও স্থানীয়ভাবে, দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি একধরনের মিসাইল বা রকেটও ব্যবহার করা হয়েছে। জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যময় ও প্রান্তিক এই জনপদে দশকের পর দশক ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। সহিংসতা ও প্রান্তিকীকরণের রাজনীতি সেখানকার মূল সংকট হয়েই থেকে গেছে। ভারতের এই উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে এখনকার অস্থিতিশীলতার নেপথ্যে আসলে কী কারণে?
গোড়ার কথা-
ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলে ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত যে সাতটি রাজ্য রয়েছে তার একটি মণিপুর। বাংলাদেশের সিলেট থেকে পূর্ব দিকে আসামের শিলচর জেলা পার হয়ে মণিপুর রাজ্যের সীমানা শুরু। বাংলাদেশের সঙ্গে মণিপুরের সীমান্ত নেই। তবে মণিপুরের পূর্বাংশে মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে এবং ওই সীমান্তে যথেষ্ট অস্থিরতাও রয়েছে। প্রকৃতিগতভাবে বৈচিত্রাময় মণিপুরে আদিযুগ থেকেই বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বসবাস এবং সেখানে পাহাড়ি ও সমতলের আদিবাসী গোষ্ঠীরা যুগযুগ ধরেই একত্রে বসবাস করে আসছে, যারা মূলত সিনো-তিব্বতি জাতিগোষ্ঠীর। তবে এদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভারতে ‘প্রিন্সলি স্টেট’ হিসেবে যে রাজ্যগুলোর মর্যাদা ছিল, তার একটি মণিপুর। কাশ্মিরের মতো মণিপুরও ভারত স্বাধীন হওয়ার পরপরই ভারতে যুক্ত হয়নি। বরং ১৯৪৯ সালে তারা ভারতের যুক্তরাজ্য ব্যবস্থায় যুক্ত হয়। মণিপুরের শাসক মহারাজা বুদ্ধচরণ ভারত সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে চুক্তি সই করেন। আর তা থেকেই ওই রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদের আন্দোলনেরও সূত্রপাত।
জাতিগত সংঘাতের সাম্প্রতিক কারণ-
মূলত সংখাগরিষ্ঠ মেইতেই সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি লাভের দাবির মধ্যে দিয়ে ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। এতে করে তারা কোটাসহ বেশ কিছু বাড়তি সুবিধা লাভ করবে। অন্যদিকে মেইতেই সম্প্রদায়ের এ দাবির জোরালো বিরোধিতা করছে কুকি সম্প্রদায়।
কেননা কুকি সম্প্রদায়ের যুক্তি হচ্ছে, ইতোমধ্যে রাজ্যটির সরকারে ও সমাজে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করেছে মেইতেই সম্প্রদায়। এমতবস্থায় তাদেরকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে তারা আরও বেশি শক্ত অবস্থান তৈরি করবে। এমনকি’ তখন সংখালঘু কুকি সম্প্রদায়ের এলাকার মেইতেই সম্প্রদায়ের লোকেরা জমি কিনতে পারবেন কিংবা বসতি স্থাপন করতে পারবেন।
এসব শঙ্কা ছাড়াও সহিংসতার পেছনে আরও অগণিত অন্তর্নিহিত কারণ রয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। কুকি সম্প্রদায়ের অভিযোগ, মেইতেই সম্প্রদায়ের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার নামে আড়ালে কুকি সম্প্রদায়কে দমনের চেষ্টা করছে।
অন্যদিকে মিয়ানমার থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশ মণিপুর রাজ্যের উত্তেজনা যেন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ভূমি ব্যবহারের উপরও চাপ সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে বেকারত্ব। আর এই বেকারত্বের কারণে যুবকদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ মিলিশিয়া বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে।
রাজ্যটিতে মেইতেই, কুকি ও নাগা সম্প্রদায়ের আলাদা আলাদা মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে উঠেছে। বাহিনীগুলো ধর্মভিত্তিক ভিন্নতা ও মাতৃভূমির দাবিতে একে অপরের সাথে যুদ্ধ করছে। এমনকি এই তিন গোষ্ঠীর প্রত্যেকেই আবার ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘাতে জড়িয়েছে।
তবে সাম্প্রতিক সহিংসতা শুধু মেইতেই ও কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যেই সংগঠিত হয়েছিল। এ বিষয়ে দ্য ফ্রন্টিয়ার মণিপুরের এডিটর ধীরেন এ সাদোকপাম বলেন, “এবার সংঘর্ষের মূলে রয়েছে। জাতিগত কারণ; ধর্ম নয়।”
মেইতেই সম্প্রদায় মণিপুর, মিয়ানমার ও আশেপাশের অঞ্চলে বসবাস করেন। এদের বেশিরভাগই হিন্দু। তবে কেউ কেউ আবার সানামাহি ধর্মের অনুসারী। অন্যদিকে কুকি সম্প্রদায়ের বসবাস উত্তর-পূর্ব ভারতজুড়ে। মণিপুরে বাস করা এ সম্প্রদায়ের অনেকেরই আবার নিজেদের মিয়ানমারের অধিবাসী বলে মনে করেন। কুকি জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগই খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী। মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষেরা বেশিরভাগই রাজ্যটির মূল শহর ইম্ফল উপত্যকায় বসবাস করে। অন্যদিকে কুকি সম্প্রদায়ের বসবাস আশেপাশের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে।
আঞ্চলিক নিরাপত্তায় কতটা ঝুঁকিপূর্ণ-
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিবেশী রাজ্য ভারতের মণিপুরের সংঘাতময় পরিস্থিতি কমার লক্ষণ নেই। মণিপুরে কুকি এবং মেইতেইদের ভয়ঙ্কর জাতি দাঙ্গার এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে অনেকে নিহত হয়েছে এবং অনেকে গুরুতর আহত হয়েছে। বিদ্রোহীরা মণিপুরের সাপ্লাই লাইন দু নম্বর জাতীয় সড়কের অবরোধও যেতে চেষ্টা করছে। যুজুধান ইউনিয়ন পিপলস ফ্রন্ট ও কুকি ন্যাশনাল এজেন্সি নিজস্ব কর্তৃত্ব বজায় রাখতে রাজনৈতিক ও সামরিক ফ্রন্টে তৎপর রয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত মণিপুর সংক্রান্ত খবরগুলোর ভিত্তিতে আঁচ করা যাচ্ছে।
গত এক বছরের বেশি সময় ধরে উত্তেজনা অব্যাহত ভারতের মণিপুরে। মণিপুর উত্তরপূর্ব ভারতের সাতটি পার্বত্য রাজ্যের একটি, যাদেরকে একত্রে ‘সেভেন সিস্টার্স বলা হয়। অতীতে নাগা, মিজো, বড়ো জাতির সশস্ত্র বিদ্রোহের কারণে উত্তরপূর্ব ভারতকে বলা হতো জাতিগত সংঘাতে অস্থির, রক্তাক্ত ও উতপ্ত অঞ্চল। মণিপুরের চলমান সন্ত্রাস, রক্তপাত ও অসন্তোষ সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতির পুনরুত্থান ঘটাচ্ছে এবং উত্তরপূর্ব ভারতে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করছে, যা থেকে আশেপাশের অঞ্চলও মুক্ত থাকতে পারবে কিনা, এমন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ, সংঘাতের কেন্দ্রস্থল বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সন্নিহিত হওয়ায় এবং বিদ্রোহী জাতিগুলো তিন দেশেই বসবাস ও অবাধে চলাচল করায় তা আঞ্চলিক নিরাপত্তা সমস্যায় রূপান্তরিত হওয়ার বিপদ উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বিশেষত, পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানে কুকি সন্ত্রাসীদের একাধিক ঘাঁটির অস্তিত্ব থাকার ফলে নিরাপত্তা বাহিনি অভিযান পরিচালনা করেছে এবং গোলাবারুদ, অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার ও কিছু সন্ত্রাসী আটক হয়েছে। তদুপরি, পাহাড়ের চলমান অস্থিতিশীল পরিবেশ এবং বান্দরবানের তিন উপজেলায় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা থাকায় পর্যটক আসছে না। পর্যটকদের আকর্ষণে নানা রকম ছাড়ের অফার দেওয়ার পরেও কম পর্যটক লক্ষ্য করা গেছে। এতে হতাশ জেলার পর্যটন ব্যবসায়ীরা। এর ফলে পর্যটন খাতে দৈনিক কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে।
এইসব তথ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যার পাশাপাশি আর্থিক সঙ্কটেরও স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে পার্বত্যাঞ্চলের ক্ষেত্রে। ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর উন্নয়ন ও সম্প্রীতির পথে চলমান পার্বত্য চট্টগ্রামে এসব বিষয় সুপ্ত হুমকি স্বরূপ এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য। আগাম অশনিসংকেতের বার্তাবাহী।
ভারতের মণিপুর রাজ্যে জাতিগোষ্ঠী সংঘর্ষে গত এক বছরে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেমে সেনাও বিক্ষোভের মুখে পড়েছে। চলমান উত্তেজনা অব্যাহত থাকায় ২০২৩ সালে মণিপুরে সফর করেছেন শাসক দল বিজেপি নেতা ও ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ এবং অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা রাহুল গান্ধী। নেতারা বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে গিয়েছেন এবং মেইতেই, কুকি ও নাগাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মণিপুর পেট্রিয়টিক পার্টি মনে করে, কংগ্রেসের আমলেই মণিপুরের এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। কংগ্রেস সরকারই ১৯৪৯ সালে স্বাধীন মণিপুরকে জোর করে ভারতে অঙ্গীভূত করেছিল। মণিপুরবাসী কখনও সেই একত্রীকরণ মানতে পারেনি বলেই রাজ্যে সশস্ত্র সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসের সূচনা হয়।
মণিপুরে কুকিরা পৃথক রাজ্য বা পৃথক প্রশাসনের জন্য যখন সরব, তখনই সেই দাবিতে ইন্ধন জুগিয়ে মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা বলছেন, ১৯৬১ সাল থেকেই তাঁর দল সব জো গোষ্ঠীকে এক ছাতার তলায় আনার জন্য লড়ছে। ফলে মণিপুরের সমস্যা যে শুধুমাত্র মণিপুর রাজ্যেই সীমাবদ্ধ নেই তা বুঝতে অসুবিধা হয়না। আশেপাশের রাজ্যে বসবাসকারী কুকি ও সমগোত্রীয় উপজাতিগুলোর মধ্যেও বিস্তৃতি লাভ করেছে।
এমতাবস্থায়, মণিপুর ও ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী মায়ানমার ও বাংলাদেশে বসবাসীকারী কুকি সম্প্রদায়ের অবস্থান নিঃসন্দেহে অনুমেয়। জাতিগত ও ধর্মীয় অভিন্নতা তথা নব্য-দীক্ষিত খ্রিস্টান পরিচিতি তাদেরকে উগ্র জাতীয়তাবাদী ‘কুকিল্যান্ড’ আন্দোলনের সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে একাত্ম করতেই পারে এবং ভারত, মায়ানমান ও বাংলাদেশে বসবাসীকারী জনগোষ্ঠীকে বৃহত্তর কুকি জাতীয়তাবাদের উন্মাদনায়-সৃষ্ট উগ্রপন্থার মাধ্যমে ‘বৃহত্তর কুকিল্যান্ড’ আন্দোলনের দিকে সশস্ত্রভাবে ঠেলে দিতে পারে। ফলে বাংলাদেশে কুকিদের সামরিক ও রাজনৈতিক তৎপরতা এবং প্রশিক্ষণ শিবির ও ঘাঁটি সংক্রান্ত তথ্যগুলোকে সামগ্রিক আঞ্চলিক পরিস্থিতির বাইরে এসে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার অবকাশ কম।
মণিপুর হাই কোর্ট মেইতেইদের তফসিলি জনজাতির মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি রাজ্য সরকারকে বিবেচনা করার নির্দেশ দিয়েছিল। এর পরেই জনজাতি সংগঠনগুলো তার বিরোধিতায় পথে। নামে। আর সেই থেকেই মণিপুরে সংঘাতের সূত্রপাত, যার নেতৃত্ব দিচ্ছে কুকি এবং সমগোত্রীয় উপজাতি গোষ্ঠীগুলো। পরবর্তীতে রাজনৈতিক আন্দোলন সশস্ত্র রূপ পরিগ্রহ করে। সরকারি অস্ত্রভাণ্ডার লুট করা ছাড়াও ভারত-মায়ানমার-বাংলাদেশের সংযোগ ত্রিভুজে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও সহজে অস্ত্রের জোগান পাওয়ার কারণে পরিস্থিতি সশস্ত্র রূপ পেতে বিলম্ব হয়নি।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মণিপুরের জ্বলন্ত পরিস্থিতি ও সন্ত্রাসের দায় আপাতদৃষ্টিতে কুকি জাতিগোষ্ঠীর দিকেই আঙুল তুলেছে। মণিপুরের এই বিশেষ সহিংস পরিস্থিতির সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা এবং দুটি জাতিগোষ্ঠীর সংঘর্ষের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিক্রিয়া ক্রিরূপ হতে পারে, তা নিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন ভারতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞগণ। ২০২০ সালে চীনা সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভয়াবহ এক সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে মণিপুরে বিদ্রোহ দমনে নিয়োজিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের সেখান থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। এখন অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার জন্য মণিপুরে আবার সৈন্য পাঠানো হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী সম্ভবত রাজ্যে স্বাভাবিক অবস্থার দ্রুত প্রত্যাবর্তনের আশা করছে, কিন্তু মোদি সরকারের কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগ ছাড়া তা অসম্ভব বলে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞগণ।
সামগ্রিকভাবে ও প্রধানত মণিপুরের সাম্প্রতিক সহিংসতাকে একটি নিরাপত্তা সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এর ঐতিহাসিক পটভূমি ও রাজনৈতিক দিকটিকে এবং ভূরাজনৈতিক গুরুত্বকে মোটেও অবজ্ঞা করা সমুচিত নয়। বিশেষত, রাজনীতি যদি বিবদমান। জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সেতু নির্মাণের বদলে বিভাজনকে আরও উস্কে দেয়, তাহলে পরিস্থিতির অবনতি ও সহিংসতার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। এই অদূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র জাতিগত সংঘাতের কারণ হয়েছে। মণিপুরের ক্ষেত্রে কুকিরা রাজনীতিবিদ ও পুলিশকে অবিশ্বাস করে। অস্ত্রাগার লুট করে। সহিংসতা পথে যেতে চায়। তেমন নাজুক ও ভঙ্গুর পরিস্থিতে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হলেও সহজে শান্তি আসেনা। সেনা ও সন্ত্রাসীদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করতেই থাকে, যা আগেভাগে রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া হলে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। ফলে শুধু মণিপুরই নয়, আশেপাশের ভারতীয় রাজ্যগুলোতেও জাতিগত অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্ব নিরসনে আলাপ-আলোচনা ও শক্তিশালী রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করাই বাঞ্ছনীয়। একইভাবে, ভারতের পার্শ্ববর্তী মায়ানমার ও বাংলাদেশের উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা অটুট রাখার জন্য প্রথমেই সামরিক প্রস্তুতির পাশাপাশি রাজনৈতিক শক্তিকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।
মণিপুরের জাতিগত সন্ত্রাসের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বও অনেক। আশেপাশের বিস্তৃত অঞ্চলে এ অশান্তি ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও রয়েছে। মিয়ানমারের চিন জনগোষ্ঠী ও বাংলাদেশের কুকি/বোম এবং ভারতের মিজোরাম রাজ্যের মিজো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কুকিদের নৃতাত্ত্বিক মিল আছে। সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে শত শত কুকি মায়ানমারে পালিয়ে গেছে। তারা বাংলাদেশেও প্রবেশ করতে পারে।
কুকিদের প্রতি অন্যায় আচরণে প্রতিবেশী রাজ্য মিজোরামেও ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। এ রাজ্যটি ১৯৮৬ সালে মিজো-নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহ থেকে বেরিয়ে এসেছিল। নাগাল্যান্ড রাজ্যে নাগাদের বিদ্রোহেও তাদের জাতিগত কুকি ভাইদের সহানুভূতি আছে। এটা বিশ্বের চলমান দীর্ঘতম বিদ্রোহগুলোর মধ্যে একটি। সেখানে নাগা জনগণ তাদের নিজস্ব পতাকা ও সংবিধান দাবি করেছে।
বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে স্থানীয় বা আঞ্চলিক বিষয় অতিদ্রুত আন্তর্জাতিক মাত্রা লাভ করে। ভারতের মণিপুর এবং তৎসংশ্লিষ্ট মায়ানমার ও বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের তটরেখায় অবস্থিত হওয়ায় বৃহত্তর ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলের প্রান্তিক অংশ। আর ইন্দোপ্যাসিফিকে আমেরিকা, আামিয়া, চীন ও ইউরোপীয় শক্তিগুলো নানা মাত্রায় তৎপর। ফলে উত্তরপূর্ব ভারত ও সন্নিকটবর্তী দেশগুলোর ঘটনাপ্রবাহ বিশ্বশক্তিসমূহের নজর ও আগ্রহের বাইরে নেই। অতএব, এসব অঞ্চলে নিরাপত্তা ঝুঁকি যতই বাড়বে, তারাও ততই নড়েচড়ে উঠবে।
সম্ভবত আঞ্চলিক গুরুত্বকে প্রাধান্য দিয়ে ২০১৫ সালে ভারত ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ তথা পূর্বদিকে সক্রিয় হওয়ার নীতি ঘোষণা করেছিল। এটা বাণিজ্য, সংস্কৃতি, জনগণের মধ্যে যোগাযোগ এবং ভৌত অবকাঠামোর মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলকে কাছের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করার ওপর জোর দেয়। কিন্তু অবকাঠামোগত অগ্রগতি সে অনুসারে হয়নি বললেই চলে: বিলম্বিত কিছু প্রকল্প শুধু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সচল হয়েছে। যদি মণিপুরের সহিংসতা রাজ্যের সীমানার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে, তবে এটি ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতিকে আরও ব্যাহত করবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। তাদের মতে, পরোক্ষভাবে নীতিটি মার্কিন ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশলের সঙ্গে জড়িত যা ‘কোয়াড’ নামক চতুর্ভুজ নিরাপত্তা সংলাপের আদলে কার্যকর হচ্ছে। ফলে সামগ্রিক পরিস্থিতির অবনতি হল ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশলের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ এমন পরিবর্তন আসতে পারে, যা আঞ্চলিক ক্ষেত্রে পরাশক্তিগুলোর পদচারণা বাড়িয়ে নানামুখী ঝুঁকিও সৃষ্টি করতে পারে।
ভারতের উত্তরপূর্বের নাজুক পরিস্থিতি বারুদভর্তি বাক্সের সমতুল্য। মণিপুরের সহিংসতা এতে ভয়ংকর স্ফুলিঙ্গ জোগাতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। অতএব ইস্যুটি ভারতীয় রাজনীতির সরাসরি অংশগ্রহণ ও হস্তক্ষেপ দাবি করে। নয়াদিল্লির উচিত, শুধু সামরিক পন্থানুসরণ না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রুটিন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সঙ্কটের নিরসন ও শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। ভারত যদি দ্রুত মণিপুরে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে না পারেন, তাহলে সীমান্তে চীনের কাছ থেকে চ্যালেঞ্জের ঝুঁকি আরও বাড়বে এবং কোয়াডের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলব। মণিপুরের মতো প্রত্যন্ত রাজ্যে সহিংসতা ও সংঘর্ষ কোনো সাধারণ নিরাপত্তা সমস্যা নয়। এই ঘটনাবলি দক্ষিণ এশিয়া এবং বিস্তৃত ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলের ভূরাজনীতিতেও ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে।
এমনই পটভূমিতে পার্শ্ববর্তী মণিপুরের ঘটনাপ্রবাহকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে বাংলাদেশকে। ঘটনার কোনও ধরণের প্রভাব মণিপুর-সংলগ্ন পার্বত্য চট্টগ্রামে যেন বিস্তার করতে না পারে, সেজন্য রাজনৈতিক, সামরিক ও কৌশলগত দিক থেকে পূর্ণ সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে বাংলাদেশকে। বর্তমানে বাংলাদেশে এমনিতেই অন্তর্বর্তীকালীন নানান চাপে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা অধিকতর জরুরি ও অগ্রাধিকারের বিষয়।