ম্যানুয়েল অ্যান্তনিও নরিয়েগা, যিনি পানামার সাবেক স্বৈরশাসক হিসেবেই পরিচিত। তিনি ১৯৩৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পানামা সিটিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার জীবনের অনেক দিকই একটি আশ্চর্য ও বিস্ময়কর গল্পের মতো। যিনি এক সময় আমেরিকার গোয়েন্দাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি পানামার এক শক্তিশালী শাসক হিসেবে আবির্ভূত হন। তবে তার শাসনকাল ছিল নানা অপরাধ, অন্ধকার এবং নিষ্ঠুরতার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। তার ক্ষমতার উত্থান, পতন এবং পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ, এসব বিষয়গুলো তার জীবনের অঙ্গীকার হয়ে উঠেছে।
নরিয়েগার শাসক হয়ে ওঠার গল্প একেবারেই সাধারণ নয়। তরুণ বয়সে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে তিনি নিজের পরিচিতি তৈরি করেন এক কঠোর, নিষ্ঠুর এবং দক্ষ সেনা কর্মকর্তা হিসেবে। বিশেষ করে তার মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ কৌশল এবং সাইক্লপস নামে পরিচিত গোপন পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা তাকে দ্রুত উপরের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার পর, তিনি বিভিন্ন গোপন চুক্তি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করতে শুরু করেন। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ক্ষমতা অর্জন এবং তিনি তা হাসিলও করেন।১৯৬৮ সালে পানামার রাষ্ট্রপতি ওমর তোরিজোসের নেতৃত্বে এক সেনা অভ্যুত্থান ঘটানো হয়। তোরিজোস রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতায় আসার পর, নরিয়েগা পানামার গোয়েন্দা প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান। তার দক্ষতা এবং সাহসিকতা তাকে তোরিজোসের বিশ্বস্ত সহযোগী করে তোলে। এরপর তিনি সিআইএ’র সহায়তায় বিভিন্ন গোপন অপারেশন পরিচালনা করেন। যার মাধ্যমে পানামাকে মার্কিন স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছিল।
১৯৮১ সালে তোরিজোসের মৃত্যুর পর নরিয়েগা পানামার শাসক হিসেবে আবির্ভূত হন। কিন্তু তার শাসন শুধু রাজনৈতিক নয় বরং অপরাধী কর্মকাণ্ডেও ভরা ছিল। পানামা ছিল মাদক পাচারের একটি কেন্দ্রবিন্দু এবং নরিয়েগা এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। তিনি কলম্বিয়ার মাদক কারবারি পাবলো এসকোবারের সঙ্গে গোপনে সহযোগিতা করেন। যার বিনিময়ে নরিয়েগা বিপুল পরিমাণ অর্থ লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে মার্কিন গোয়েন্দারা নরিয়েগার মাদক পাচারের কার্যক্রমের উপর নজর রাখতে শুরু করে।
১৯৮৩ সালের মধ্যে নরিয়েগার বিরুদ্ধে মার্কিন গোয়েন্দারা যথেষ্ট তথ্য ও প্রমাণ সংগ্রহ করে। কিন্তু মধ্য আমেরিকায় স্নায়ুযুদ্ধের পরিস্থিতি থাকায় মার্কিন সরকার তার বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযান চালাতে তেমন আগ্রহী ছিল না। তারা পানামাকে একটি ‘বাফার অঞ্চল’ হিসেবে দেখত। যেখানে বামপন্থী আন্দোলন ঠেকাতে নরিয়েগা কাজে লাগছিল।
১৯৮৫ সালে পানামায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নিকোলা আদ্রিতো বারলেতা জয়ী হলেও নরিয়েগা তা মেনে নেননি। তিনি নির্বাচনের ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করে পানামার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেন। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং পানামা খালকে নিয়ে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পানামা খাল ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি সমুদ্রপথ, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ স্বার্থের মধ্যে একটি ছিল।
নরিয়েগার শাসনকালে, পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ আরো বৃদ্ধি পায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ১৯৭৭ সালে পানামা খাল চুক্তি স্বাক্ষর করেন। যার মাধ্যমে পানামা সরকারকে খালের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয়েছিল। যদিও এই চুক্তি তৎকালীন মার্কিন প্রশাসনের জন্য বিতর্কিত ছিল। পরবর্তী সময়ে রোনাল্ড রিগ্যান, জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ এবং বিল ক্লিনটন প্রশাসনও এর শর্ত মেনে চলে। তবে নরিয়েগা তার শাসনের শেষ পর্যায়ে পানামা খালকে পুনরায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়েন।
নরিয়েগা ১৯৮৮ সালে কোকেইন চোরাচালান ও অর্থপাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হন। যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে চাপ তৈরি করতে বিভিন্ন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে নরিয়েগা কোনওভাবেই এই চাপের কাছে পরাস্ত হননি। বরং তিনি ১৯৮৯ সালে পানামার জাতীয় পরিষদ তাকে সর্বোচ্চ নেতা ঘোষণা করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।এই ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ছিল একটি চ্যালেঞ্জ। ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরের ২০ তারিখে, যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা ‘অপারেশন জাস্ট কজ’ নামে পানামায় একটি সামরিক অভিযান শুরু করে। যার লক্ষ্য ছিল নরিয়েগাকে গ্রেপ্তার করে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসা। অভিযানের ফলস্বরূপ, নরিয়েগা পানামা সিটির ভ্যাটিকান দূতাবাসে আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি নারী সেজে আত্মগোপন করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু অবশেষে ১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে তিনি আত্মসমর্পণ করেন।
এটি ছিল নরিয়েগার শাসনের পতনের চূড়ান্ত মুহূর্ত। তাকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসা হয় এবং সেখানে ৪০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
নরিয়েগার গ্রেপ্তারের পর, ১৯৯০ সালে তাকে যুক্তরাষ্ট্রে আনা হয় এবং ৪০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই সময় থেকে তার জীবন ছিল কারাগারে কাটানো এক অসহনীয় যন্ত্রণা। তার বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড, মাদক পাচার, অর্থপাচারসহ নানা গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছিল। কারাগারে নরিয়েগা বেশিরভাগ সময়ই একাকী জীবন কাটিয়েছেন। যদিও তার শাসনকাল ছিল বাহুবলী। একসময় তিনি পানামার রাষ্ট্রপতি, সেনাবাহিনীর প্রধান এবং গোয়েন্দাবাহিনীর নেতা ছিলেন। অথচ পরে তিনি একটি সাধারণ বন্দী।
তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল মধ্য আমেরিকার স্নায়ুযুদ্ধের সময় ওয়াশিংটনের পক্ষে কাজ না করার কারণে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা। নরিয়েগা অবশ্য দাবি করেছিলেন, তিনি জাতীয়তাবাদী এক বীর হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার এসব দাবি কেউ গ্রহণ করেনি। বিপুল পরিমাণ দুর্নীতি ও অশান্তির জন্য পানামা তার শাসনকালে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল।২০১০ সালে প্রায় ১৭ বছর যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে কাটানোর পর, নরিয়েগাকে ফ্রান্সে পাঠানো হয়। সেখানে অর্থপাচারের দায়ে তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। ফ্রান্সে কিছু সময় বন্দী থাকার পর ২০১১ সালে তাকে পানামা ফেরত পাঠানো হয়। তবে তখন তার শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণে তিনি কারাগারে না থেকে চিকিৎসার জন্য মনোযোগী হন। পানামা ফেরার পর তিনি দুঃখিত হয়ে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
পানামার শাসক হিসেবে তার মৃত্যুর পর, নরিয়েগার প্রভাব অনেকটাই ধীর হয়ে যায়। ২০১১ সালে, পানামায় ফিরে আসার পর তার ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয় এবং সেই ভবনটিও ধ্বংস করা হয় যেখানে তিনি বিলাসবহুল জীবন কাটাতেন। এভাবে দেশের ইতিহাসে তিনি যে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিলেন তা নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়ে যায়।
তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন, তার প্রতি বিরোধী নেতা ও সাধারণ মানুষের ক্ষোভও কমেনি। নরিয়েগা সরকারের দুর্নীতি, মাদক পাচার এবং স্বৈরাচারী শাসনের কারণে পানামায় বহু বছর ধরে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছিল। তবে তার বিপরীতে কিছু মানুষ তাকে একজন জাতীয় নেতা হিসেবে মানতে চেয়েছিলেন। বিশেষত মধ্য আমেরিকায় স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মার্কিন প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে চাওয়ার জন্য তার তৎকালীন রাজনৈতিক কার্যক্রমও প্রশংসিত হয়েছিল।
নরিয়েগার শাসনের সময় পানামা খাল ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়। পানামা খাল ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি নীতিগত এবং ভূরাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি পশ্চিম এবং পূর্বের মধ্যে একটি সরাসরি জলপথ প্রদান করেছিল। যা মার্কিন ব্যবসা এবং সামরিক কার্যক্রমের জন্য অপরিহার্য ছিল।১৯৭৭ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ পানামা সরকারের কাছে হস্তান্তরের একটি চুক্তি করেন। যা পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে পূর্ণভাবে কার্যকর হয়। কিন্তু নরিয়েগার শাসনকালে পানামা খালকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরো অবনতির দিকে যায়।
তিনি কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো এবং লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করার পর, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে শুরু করেন। পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। যা তার পতনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ম্যানুয়েল নরিয়েগার শাসন ছিল এক অন্ধকার অধ্যায়। যদিও তিনি এক সময় নিজেকে পানামার স্বাধীনতা ও জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। তার শাসনের বাস্তবতা ছিল একেবারে ভিন্ন। দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, মাদক পাচার ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সাথে অগোচরে কাজ করা। তার শাসনের নকশাকে একেবারে কলঙ্কিত করে দিয়েছে। তবে অনেক সমালোচকের মতে, তার শাসনেও কিছু ইতিবাচক দিক ছিল। বিশেষত পানামাকে মধ্য আমেরিকার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। কিন্তু তার নিজস্ব স্বার্থের প্রাধান্য এবং মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্কের কারণে তার শাসন একটি অন্ধকার পর্বে পরিণত হয়।নরিয়েগা চেয়েছিলেন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে বিশ্বমঞ্চে আত্মপ্রকাশ করতে। কিন্তু তার কার্যকলাপের মাধ্যমে তিনি জাতির জন্য যে ক্ষতি করেছেন, তা কোনোভাবেই মাফ করা সম্ভব নয়। তিনি পানামার স্বাধীনতা ও সশস্ত্র বাহিনীর শক্তির প্রতীক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার মধ্যে ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রতি যে আগ্রহ ছিল। তা তাকে শেষ পর্যন্ত পতনের দিকে ঠেলে দেয়।
পরিশেষ বলা যায় ম্যানুয়েল নরিয়েগা আজ আর পানামার শাসক হিসেবে নেই। তবে তার শাসনের ধ্বংসাত্মক ফলাফল দেশটির ইতিহাসে চিরকাল থাকবে। তার শাসন, উত্থান, পতন এবং পরবর্তী সময়ের ঘটনাবলী বিশ্ব রাজনীতির এক নিষ্ঠুর এবং অত্যন্ত শিক্ষা দেওয়া অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। তার জীবন ও কর্মকাণ্ড শুধু পানামা নয় বরং পুরো মধ্য আমেরিকার জন্য একটি সতর্কীকরণ। যা দেখায় কিভাবে একনায়কত্ব, দুর্নীতি এবং আত্মসংশোধনের অভাব একটি জাতিকে বিপথগামী করে ফেলতে পারে।