বর্তমানে বিশ্ব নজর রেখেছে মধ্যপ্রাচ্যের এক উত্তপ্ত সংঘাতের দিকে—ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সামরিক উত্তেজনা নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। সম্প্রতি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরান যে শত শত ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে, তার মধ্যে বেশিরভাগই ছিল ব্যালিস্টিক মিসাইল। এদের কিছু মাঝপথেই প্রতিরোধ করা গেলেও, বেশ কয়েকটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে, যার ফলে তেলআভিভসহ বিভিন্ন এলাকায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
এই পটভূমিতে অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে—ব্যালিস্টিক মিসাইল আসলে কী? কীভাবে এটি এত দ্রুত এবং এতদূর গিয়ে আঘাত হানতে পারে? এবং, কেন এগুলো প্রতিরোধ করা এত কঠিন? চলুন বিষয়টি সহজভাবে বিশ্লেষণ করি।

ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কীভাবে কাজ করে?
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হচ্ছে এমন এক ধরণের দূরপাল্লার অস্ত্র, যা মাটির ওপর থেকে অনেক উঁচুতে, কখনো কখনো মহাকাশ পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং এরপর গ্রহের অভিকর্ষ বলের কারণে নিচে নেমে এসে নির্ধারিত লক্ষ্যে আঘাত হানে।
এর কার্যপ্রণালি মূলত তিনটি ধাপে বিভক্ত:
উৎক্ষেপণ ধাপ (Boost Phase): ক্ষেপণাস্ত্রটি শক্তিশালী রকেট ইঞ্জিনের সাহায্যে উপরের দিকে উৎক্ষেপণ করা হয়। এই ধাপে এটি শব্দের গতির অনেক গুণ গতিতে চলে যায়।
মধ্যবর্তী ধাপ (Midcourse Phase): একবার ইঞ্জিন বন্ধ হলে এটি ভূপৃষ্ঠ থেকে কয়েকশো কিমি ওপরে গিয়ে বক্র পথে চলতে থাকে। এটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরেও পৌঁছে যেতে পারে।
পুনঃপ্রবেশ ও আঘাত (Re-entry Phase): এরপর এটি আবার মাটির দিকে নেমে আসে, এবং অত্যন্ত দ্রুতগতিতে নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে।
এ ধরণের ক্ষেপণাস্ত্র একবার উৎক্ষেপণ করলে সেটিকে থামানো বা তার পথ পরিবর্তন করানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কত দূর পর্যন্ত যেতে পারে?
ব্যালিস্টিক মিসাইলগুলোর ভৌগোলিক পরিসীমা অনুযায়ী এগুলোকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়:
- বেটেলফিল্ড রেঞ্জ ব্যালিস্টিক মিসাইল (BRBM): ২০০ কিমি’র নিচে। এটি মূলত স্থানীয় যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য।
- শর্ট-রেঞ্জ ব্যালিস্টিক মিসাইল (SRBM): ১,০০০ কিমি’র কম দূরত্বে পৌঁছাতে সক্ষম।
- মিডিয়াম/ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ (MRBM/IRBM): ১,০০০ কিমি থেকে শুরু করে ৩,৫০০ কিমি পর্যন্ত যেতে পারে। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে এই ধরণের ক্ষেপণাস্ত্রই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়।
- লং-রেঞ্জ ব্যালিস্টিক মিসাইল (LRBM): ৩,৫০০ কিমি থেকে ৫,৫০০ কিমি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
- ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল (ICBM): ৫,৫০০ কিমির বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে, যা এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশেও আঘাত হানতে সক্ষম।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি এতটাই বিস্তৃত যে তারা বিভিন্ন পাল্লার একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র একসাথে উৎপাদন ও সংরক্ষণ করে।
গতি কতটা ভয়ঙ্কর?
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর অতিদ্রুত গতি। এদের গতি সাধারণত “মাখ” (Mach) এককে পরিমাপ করা হয়, যেখানে Mach ১ মানে শব্দের গতি—প্রায় ১,২২৫ কিমি/ঘণ্টা।
- স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সাধারণত সুপারসনিক (Mach ১ থেকে Mach ৫) গতিতে চলে।
- দীর্ঘ পাল্লারগুলো হাইপারসনিক, অর্থাৎ Mach ৫ এর বেশি গতি অর্জন করে, যা ঘণ্টায় প্রায় ৬,১২৫ কিমি’র সমান।
এই কারণে, একবার আকাশে ছোড়া হলে এসব মিসাইল চোখের পলকে লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছে যায়।
ইরান থেকে ইসরায়েল—সময় লাগে কতটুকু?
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি দূরত্ব আনুমানিক ১,৩০০ থেকে ১,৫০০ কিমি। যদি একটি ক্ষেপণাস্ত্র Mach ৫ গতিতে চলে, তাহলে এটি মাত্র ১২ মিনিটে ইসরায়েল পৌঁছাতে পারে। তুলনামূলকভাবে, একটি ক্রুজ মিসাইল সেখানে পৌঁছাতে প্রায় ২ ঘণ্টা সময় নেয়, আর ড্রোনগুলো নিতে পারে ৯ ঘণ্টা পর্যন্ত।
এই সময়ের পার্থক্য ইসরায়েলের জন্য প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।

ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রতিহত করা এত কঠিন কেন?
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধের জন্য সময় অত্যন্ত সীমিত। কারণ, এটি আকাশের অনেক ওপরে উঠার পর আকস্মিক গতিতে নিচে নেমে আসে। এমনকি অনেক মিসাইলে কৃত্রিম বিভ্রান্তি (decoys), রাডার ব্লকার বা রুট চেঞ্জার বসানো থাকে, যা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত করে।
সাধারণত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তিনটি স্তরে কাজ করে—নিচু, মাঝারি ও উচ্চ স্তরে। কিন্তু ব্যালিস্টিক মিসাইল এত তীব্র গতিতে পুনঃপ্রবেশ করে যে এগুলোকে মাঝপথে থামানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
ক্রুজ মিসাইল ও ব্যালিস্টিক মিসাইল—তাদের পার্থক্য কী?
ইরান শুধু ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রই নয়, ক্রুজ মিসাইলও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। এদের গতি কম হলেও কৌশলগত সুবিধা রয়েছে:
- ক্রুজ মিসাইল নিচু দিয়ে চলে, যেন রাডারে ধরা না পড়ে।
- এগুলো নির্দিষ্ট পথ ধরে চলা ছাড়াও পথ পরিবর্তন করতে পারে, যা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জে ফেলে।
- যদিও এদের গতি ব্যালিস্টিক মিসাইলের তুলনায় অনেক কম, কিন্তু এদের চলাফেরা অনেকটা চালকহীন বিমানের মতো।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডার কতটা বড়?
ইরান বিগত ৩০ বছর ধরে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছে। তাদের হাতে রয়েছে:
- শেহাব সিরিজের মিসাইল (Shahab-3)
- ফতেহ-১১০ (Fateh-110)
- খোরামশাহর (Khorramshahr)
- হাজির (Haj Qassem)
- এবং আরও অনেক
এদের মধ্যে কয়েকটি মিসাইলের পাল্লা ২,০০০ কিমির বেশি, যা ইসরায়েল ছাড়াও সৌদি আরব, কাতার, এমনকি ইউরোপীয় অঞ্চলের কিছু অংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কতটা শক্তিশালী?
ইসরায়েল বহু বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। তাদের অন্যতম শক্তিশালী অস্ত্র হলো:
- Iron Dome: স্বল্প পাল্লার রকেট প্রতিহত করতে ব্যবহৃত হয়। এটি রাডারের সাহায্যে আগত রকেট শনাক্ত করে এবং সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস করে।
- David’s Sling: ৪০ কিমি থেকে ৩০০ কিমি দূরত্বের ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে ব্যবহৃত হয়।
- Arrow System: ২,৪০০ কিমি পর্যন্ত দূরত্বের হুমকি প্রতিহত করতে সক্ষম। এটি মূলত ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রতিরোধের জন্য তৈরি।
এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলো মিলে ইসরায়েলের আকাশকে একটি প্রযুক্তিনির্ভর ঢালে রূপ দিয়েছে।
বর্তমান ইরান-ইসরায়েল সংঘাত শুধু দুই দেশের মধ্যকার যুদ্ধই নয়—এটি আধুনিক প্রযুক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কৌশলগত চালচিত্র এবং আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিচ্ছবি।ব্যালিস্টিক মিসাইল এখন আর শুধু যুদ্ধের অস্ত্র নয়, বরং এটি কূটনৈতিক বার্তার একটি রূপও হয়ে উঠেছে। একেকটি উৎক্ষেপণ যেন একেকটি সতর্কবার্তা—যুদ্ধ চাই না, কিন্তু প্রস্তুত আছি।