দুই দশকের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, নেটো বাহিনীর আগ্রাসন এবং পশ্চিমা-সমর্থিত দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের পতনের পর ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়। সেই দিন থেকেই আফগানিস্তানে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়।
বন্দুকের গর্জন থেমে যায়। তালেবান সরকার উন্নয়ন, স্বনির্ভরতা, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও শরিয়াভিত্তিক বিচারব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দেয়। তখন অনেকেই ভেবেছিলেন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পাওয়া এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার চাপে তালেবান সরকার দ্রুত ভেঙে পড়বে। কিন্তু বাস্তবতা হয়েছে উল্টো।
গত চার বছরে তালেবান সরকার এমন কিছু সাফল্য দেখিয়েছে যা শুধু আফগানদের আস্থা ফেরায়নি বরং পুরো বিশ্বে একটি নতুন ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে। ২০২৩ সালে আফগান মুদ্রা ‘আফগানি‘ পারফরম্যান্সে মার্কিন ডলারসহ বিশ্বের অনেক শক্তিশালী মুদ্রাকে ছাড়িয়ে যায়।
ভয়েস অফ আমেরিকা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানায়, বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে ‘আফগানি’ ছিল বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ও স্থিতিশীল মুদ্রা। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে মুদ্রাস্ফীতি প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। আয়কর, শুল্ক ও অন্যান্য উৎস থেকে রাজস্ব আদায় দাঁড়ায় ১৫৪ কোটি ডলারে, যা পূর্ববর্তী কোনো সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
রপ্তানি আয় ৯০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১.৭ বিলিয়ন ডলারে, যেখানে ২০২০ সালে তা ছিল মাত্র ৮০০ মিলিয়ন।
২০০১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত আফগানিস্তান ছিল বিশ্বের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। কোটি কোটি ডলারের বিদেশি ত্রাণ গেলেও সাধারণ মানুষের জীবনে এর তেমন প্রভাব পড়েনি। কিন্তু তালেবান সরকার মাত্র দুই বছরের মধ্যে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরে স্বচ্ছ প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেছে।
এতে আফগান জনগণের মধ্যে সরকারের ওপর আস্থা বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে।
এক সময় আফগানিস্তান ছিল বিশ্বের শীর্ষ পপি উৎপাদনকারী দেশ। চাষ হতো ২ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০২৩ সালে তা কমে দাঁড়ায় মাত্র ১০ হাজার ৮০০ হেক্টরে- প্রায় ৯৫ শতাংশ হ্রাস। ২০২৫ সালে এসে তালেবান সরকার দাবি করছে, দেশের বেশিরভাগ প্রদেশেই পপি চাষ বন্ধ।
এটা শুধু আফগান সমাজ নয়, গোটা বিশ্বে মাদক নিয়ন্ত্রণে বড় অর্জন।
তালেবান সরকারের সবচেয়ে বড় প্রকল্প ‘কামাল খাল’ (কুষ্ঠ বা কেনেল খাল) যা ১০৮ মিটার প্রশস্ত ও ২৮৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। এটি নির্মিত হচ্ছে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়ন ও প্রযুক্তিতে। এই খাল সেচের আওতায় আনবে প্রায় ৬ লাখ হেক্টর জমি। উৎপাদিত গম, তেলবীজ ও অন্যান্য খাদ্যশস্যে দেশটি হয়ে উঠবে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
এ প্রকল্পে কর্মসংস্থান হবে আড়াই লাখ মানুষের। কোনো বিদেশি ঋণ বা সাহায্য ছাড়া এমন উদ্যোগ আজকের বিশ্বেও বিরল।
আফগানিস্তান প্রযুক্তি খাতেও এগোচ্ছে। দেশীয় প্রযুক্তিতে সুপারকার তৈরির ঘোষণা দিয়েছে তালেবান সরকার। রপ্তানি হচ্ছে “খোলাসা” নামের ডালিমের রসজাত পানীয়, যার বাজার এখন ছড়িয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত।
এগুলো প্রমাণ করে, তালেবান সরকার কেবল ধর্মভিত্তিক শাসনে সীমাবদ্ধ নয়- তারা বাস্তবভিত্তিক উৎপাদন, উদ্ভাবন ও স্বনির্ভরতার দিকেও গুরুত্ব দিচ্ছে।
ক্ষমতায় এসেই তালেবান শরিয়াভিত্তিক আদালত চালু করে। এসব আদালত শুধু শাস্তি নয়, দ্রুত বিচার ও ন্যায়ের উপর জোর দিয়েছে। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে কার্যক্রম পরিচালনার ফলে জনগণের মধ্যে বিচারব্যবস্থা নিয়ে আস্থা ফিরেছে।
তালেবান সরকার শুধু নিজেদের গোষ্ঠী নয়, দেশের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকেও সংলাপে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানায়। অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ কমিয়ে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগটি বিশ্ব রাজনীতিতে ব্যতিক্রমী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পেলেও চীন, রাশিয়া, তুরস্ক, সৌদি আরব, কাতার ও আরব আমিরাতের সঙ্গে নিয়মিত কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখছে তালেবান সরকার। ইতিমধ্যে প্রায় ৬৫০ কোটি ডলারের চুক্তি সই হয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কোম্পানির সঙ্গে। এসব বিনিয়োগে দেশের খনিজ খাতে বিপুল উন্নয়ন হচ্ছে।
বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান খনিজ লিথিয়াম, সোনা, তামা, লোহা- সবকিছুই মজুত রয়েছে আফগানিস্তানের মাটির নিচে। চীন এরইমধ্যে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই খনিজ সম্পদ ভবিষ্যতে আফগান অর্থনীতিকে দুর্দান্ত উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারে।
তালেবান সরকারের শাসন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও একটি বিষয় অস্বীকার করার উপায় নেই- ২০২১ সালের পর তারা আফগানিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড় করাতে পেরেছে। ভেঙে পড়া প্রশাসন, সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোকে নতুনভাবে গড়ে তোলার সাহসিকতা দেখিয়েছে তারা।
যারা আফগানিস্তানকে যুদ্ধ আর ধ্বংসের প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখতেন, তাদের জন্য তালেবান-শাসিত দেশটি এখন এক নতুন বাস্তবতা। যেখানে সীমিত সম্পদ, আন্তর্জাতিক চাপ ও স্বীকৃতিহীনতার মাঝেও একটি জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর গল্প লিখছে।