বাণিজ্যিক বিমানের সাফল্য মাপার ক্ষেত্রে উৎপাদনের সংখ্যা একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। বোয়িং ৭৩৭ ও এয়ারবাস এ৩২০ বিমানগুলি যদিও আধুনিক প্রযুক্তিতে পরিপূর্ণ কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত বাণিজ্যিক বিমান ডগলাস ডিসি-৩।
২০২৪ সাল পর্যন্ত বোয়িং ৭৩৭-এর প্রায় ১২ হাজার এবং এয়ারবাস এ৩২০-এর ১১ হাজার ৫২৪টি বিমান উৎপাদিত হলেও, ডিসি-৩-এর সংখ্যা ১৩ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। মাত্র এই তথ্য দিয়েই বোঝা যায় এর সাফল্য ও প্রভাব কত বিস্তৃত।
ডিসি-৩ প্রথম উড্ডয়ন করে ১৯৩৫ সালে। এটি বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ শিল্পে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। এর আগের বিমানের জ্বালানি ধারণক্ষমতা কম ছিল এবং দীর্ঘ দূরত্বে উড়তে পারত না। উদাহরণস্বরূপ, নিউইয়র্ক থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস যাওয়ার পথে আগের বিমানগুলো প্রায় ১৫ বার জ্বালানি পূরণে থামত, যেখানে ডিসি-৩ মাত্র তিনবার ফুয়েল স্টপ করে।
১৯৪০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বিমানে ভ্রমণকারী ২০ লাখের অধিক মানুষের মধ্যে অধিকাংশই ডিসি-৩-তে ভ্রমণ করতেন। শতবর্ষের কোঠায় পৌঁছে গেলেও আজও ডিসি-৩ আকাশে সক্রিয় আছে, বাণিজ্যিক প্রয়োজনে।
১৯৩০-এর দশকে বাজারে আসা ডিসি-৩ এককভাবে আকাশযাত্রার মান পরিবর্তন করেছিল। তখন এর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল বোয়িং ২৪৭, যা ডিসি-৩ থেকে দুই বছর আগেই চালু হয়েছিল। তবে জনপ্রিয়তায় ডিসি-৩ বোয়িং ২৪৭-কে ছাড়িয়ে যায়। ১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৩০০ এয়ারলাইনের মধ্যে ২৭৫টি ডিসি-৩ ব্যবহার করত।
ডিসি-৩ তৈরি হয়েছিল পূর্বের মডেল ডিসি-২-এর ওপর ভিত্তি করে। ডিসি-২-তে সাধারণত ১৪ জন যাত্রী বসত কিন্তু ডিসি-৩-তে জায়গা বাড়িয়ে ২১ থেকে ২৮ জন পর্যন্ত যাত্রী নিতে পারত।
এই বিমানটি দুটি রাইট এসজিএম ১৮২০–৭১ মডেলের ইঞ্জিন দ্বারা চালিত, যাদের প্রতিটি ১২০০ হর্সপাওয়ার শক্তি উৎপন্ন করে। ১০ হাজার ফুট উচ্চতায় ১৮৫ মাইল গতি দিয়ে প্রায় ২১০০ মাইল পর্যন্ত অনায়াসে উড়তে সক্ষম।
ডিসি-৩-র যাত্রীরা অভিজ্ঞতাও ছিল অন্যরকম। ওরভিল রাইট একবার বলেছেন, ‘বিমানটি এত সাউন্ড-প্রুফ যে যাত্রীরা চেঁচামেচি না করে স্বাভাবিকভাবেই কথা বলতে পারে।’ পাইলটরাও এটিকে পছন্দ করতেন কারণ এটি সহজে নিয়ন্ত্রণযোগ্য, এক ইঞ্জিনে চালানো যেত এবং নিরাপদে অবতরণ করানো সহজ।
১৯৩৫ সালে প্রথম উড়োজাহাজটি আকাশে উঠলেও কেউ ভাবেনি এটি শতবর্ষ ছুঁবে। আজও প্রায় ১৭২টি ডিসি-৩ সক্রিয় রয়েছে, যার মধ্যে কানাডার বাফেলো এয়ারওয়েসের তিনটি বিমান উল্লেখযোগ্য।
এর দীর্ঘস্থায়ীতার রহস্য হলো মজবুত প্রকৌশল এবং নিরাপত্তা ভিত্তিক ডিজাইন। বিমানের কাঠামো এতটাই শক্তিশালী যে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি টেকসই করা হয়েছিল। ডিসি-৩ প্রেসারাইজড নয়, অর্থাৎ এর কেবিনে বাতাসের চাপ নিয়ন্ত্রিত না হওয়ায় ফুসেলাজের ওপর চাপ কম পড়ে, যা আয়ু বাড়ায়। নকশার সরলতা এবং যান্ত্রিকতার কারণে এর কার্যক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের একজন ডিসি-৩ অপারেটর মাইক উডলি বলেন, ‘এটা খুবই সাধারণ বিমান, একেবারে ঘড়ির মতো চলে। এতে কোনো হাইড্রোলিক কন্ট্রোল নেই।’
ডগলাস ডিসি-৩ আজও বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগত উড়োজাহাজ হিসেবে অব্যাহত রয়েছে, যা এর সময়ের বাইরে স্থায়িত্বের প্রতীক।

