জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে যে, উত্তর কোরিয়ায় মৃত্যুদণ্ডের হার ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষত বিদেশি সিনেমা, টেলিভিশন নাটক দেখা বা শেয়ার করার অভিযোগে বহু মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, কিম জং উন সরকারের শাসনকালে নাগরিকদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণের মাত্রা আরো কঠোর হয়েছে এবং প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে নজরদারি এখন আরো ব্যাপক।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক সতর্ক করে বলেছেন, “যদি এই পরিস্থিতি চলতে থাকে, জনগণ আরো ভোগান্তি, নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন এবং দীর্ঘদিনের ভয়ের শিকার হবে।” তিনি আরো উল্লেখ করেন, “বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণের বিপরীতে একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।”
প্রতিবেদন ও সাক্ষাৎকারের ভিত্তি-
জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা ৩০০ জনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে। এতে বলা হয়েছে, দেশের আইনকানুনে নতুন করে অন্তত ছয়টি বিধান চালু হয়েছে, যা বিদেশি চলচ্চিত্র বা নাটক দেখাকে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ হিসেবে নির্ধারণ করেছে।
২০১৫ সালের পর থেকে এই ধরনের শাস্তির ঘটনা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব শাস্তি জনসমক্ষে কার্যকর করা হয়, যাতে সাধারণ মানুষ ভয় পায় এবং আইন লঙ্ঘন না করে।

বিবিসি অনুসারে, পালিয়ে আসা কাং গিউরি। যিনি ২০২৩ সালে দেশ ত্যাগ করেছেন- তিনি জানান, তার তিন বন্ধু দক্ষিণ কোরিয়ার কনটেন্ট রাখার দায়ে মৃত্যুদণ্ড পেয়েছে। তিনি দেখেছিলেন, ২৩ বছরের এক বন্ধুকে মাদক অপরাধীদের মতোই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কাং উল্লেখ করেন, “২০২০ সালের পর এসব অপরাধকে একইভাবে দেখা হয় এবং মানুষ আরো ভীত হয়ে পড়েছে।”
মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি-
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে কিম জং উন ক্ষমতায় আসার পর অনেক নাগরিক আশা করেছিলেন যে, তাদের জীবনমান উন্নত হবে এবং আর ‘অনাহারে’ থাকতে হবে না। তবে ২০১৯ সালে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে কূটনীতি এড়িয়ে অস্ত্র কর্মসূচিতে জোর দেওয়ার পর মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি ঘটে।
অধিকাংশ সাক্ষাৎকারদাতা জানান, তারা পর্যাপ্ত খাবার পাননি। দিনে তিন বেলা খাওয়া ছিল বিলাসিতা এবং করোনা মহামারির সময় তীব্র খাদ্যসংকট দেখা দেয়, ফলে অনেকে অনাহারে মারা যান।
এক তরুণী, যিনি ২০১৮ সালে দেশ ত্যাগ করেন, বলেন, “কিম জং উনের শুরুর দিকে কিছুটা আশা ছিল। কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সরকার ধীরে ধীরে মানুষকে স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ বন্ধ করে দেয়। বেঁচে থাকাই হয়ে দাঁড়ায় এক যন্ত্রণা।”
নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ-
গত এক দশকে সরকার অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সব ক্ষেত্রে প্রায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। আধুনিক নজরদারি প্রযুক্তি এই নিয়ন্ত্রণকে আরো শক্তিশালী করেছে।
পালিয়ে আসা এক নাগরিক বলেন, “এই দমননীতি আসলে মানুষের চোখ-কান বন্ধ করার চেষ্টা, যাতে সামান্যতম অসন্তোষও মুছে ফেলা যায়।” প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারি নজরদারি ও তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে যে কোনো অপ্রিয় আচরণ প্রতিহত করা হচ্ছে।
জোরপূর্বক শ্রম ও অনাথদের ব্যবহার-
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, উত্তর কোরিয়ায় জোরপূর্বক শ্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। দরিদ্র পরিবারের মানুষদের ‘শক ব্রিগেডে’ ভর্তি করা হচ্ছে, যেখানে নির্মাণ ও খনির মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব কাজে অনেকের মৃত্যু ঘটে।

তবে সরকার মৃত্যুকে কিম জং উনের প্রতি ‘ত্যাগ’ হিসেবে মহিমান্বিত করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাজারো অনাথ ও পথশিশুকেও এসব কাজে যুক্ত করা হয়েছে।
২০১৪ সালে জাতিসংঘ প্রথমবার বলেছিল, উত্তর কোরিয়ার সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত। তখন রাজনৈতিক কারাগারে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল।
সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্তত চারটি রাজনৈতিক কারাগার এখনও চালু রয়েছে। সাধারণ কারাগারগুলোতেও নির্যাতন, অতিরিক্ত শ্রম ও অপুষ্টির কারণে বন্দিদের মৃত্যু ঘটছে। যদিও কারারক্ষীদের সহিংসতা সামান্য কমেছে বলে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া-
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে, উত্তর কোরিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতি নজরদারির আওতায় আনা হোক। বিশেষত রাজনৈতিক কারাগার উচ্ছেদ, মৃত্যুদণ্ড বন্ধ এবং মানবাধিকার শিক্ষার ব্যবস্থা প্রয়োজন।
মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ভলকার তুর্ক বলেন, “আমাদের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের প্রবল আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, যা সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণের বিপরীতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত।”
যাইহোক, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পদক্ষেপে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিষয়টি প্রেরণ সম্ভব নয়, যা চীন ও রাশিয়ার বিরোধিতায় আটকে আছে।
গত সপ্তাহে পিয়ংইয়ংয়ের নেতা কিম জং উন বেইজিংয়ে সামরিক কুচকাওয়াজে অংশ নেন। সেখানে তার পাশে ছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
বিশ্লেষকের মতে, এটি মানবাধিকার পরিস্থিতি ও উত্তর কোরিয়ার কর্মসূচিতে ওই দেশগুলোর নীরব সমর্থনের ইঙ্গিত।

শিক্ষাগত ও সামাজিক প্রভাব-
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই দমননীতি শুধুমাত্র শাস্তি প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি শিক্ষাগত এবং সামাজিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। দেশের যুবসমাজ স্বাধীনভাবে তথ্য, সংস্কৃতি এবং বিনোদন গ্রহণে অক্ষম হয়ে পড়েছে। বিদেশি সিনেমা, নাটক বা গণমাধ্যমের মাধ্যমে বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হচ্ছে।
এই পরিস্থিতি যুবসমাজের মানসিক ও সামাজিক বিকাশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি দমননীতি কেবল মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সীমিত করছে না, বরং সমাজের উদ্ভাবনী শক্তি ও সমন্বয়মূলক বিকাশকেও ব্যাহত করছে।
পরিশেষে, উত্তর কোরিয়ায় মৃত্যুদণ্ডের হার বৃদ্ধি, কঠোর নজরদারি, জোরপূর্বক শ্রম, খাদ্যসংকট এবং রাজনৈতিক কারাগারগুলোতে অমানবিক আচরণ—এসব মিলিতভাবে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে চরম সংকটে পৌঁছে দিয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে, সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে আরো শক্তিশালী হয়েছে এবং জনগণের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর পদক্ষেপ এবং মানবাধিকার রক্ষায় উদ্যোগ নেওয়া না হলে, এই সংকট দীর্ঘমেয়াদি ও আরও ভয়ঙ্কর হবে।
এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে, উত্তর কোরিয়ার নাগরিকরা শুধু রাজনৈতিক ও সামাজিক দমননীতি নয়, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও মানবিক অধিকারও হারাচ্ছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে, দেশটির জনগণ দীর্ঘদিনের ভয়, দমন-পীড়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে থেকে মুক্তি পাবে না।

