অবরুদ্ধ গাজা সিটিতে ইসরাইলি সেনাবাহিনী ১২ লাখের বেশি ফিলিস্তিনিকে তাৎক্ষণিকভাবে শহর ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে। শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) এক ঘোষণায় ইসরাইলি সেনারা জানিয়েছে, শহরের বাকি বাসিন্দাদের দক্ষিণে আল-মাওয়াসি এবং কেন্দ্রীয় রিফিউজি ক্যাম্পের দিকে সরতে হবে। নির্দেশের পেছনে মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে শহরে ক্রমবর্ধমান বিমান হামলা ও স্থল অভিযান।
ইসরাইলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আবিচাই অদরায়ি এক বিবৃতিতে বলেন, আড়াই লাখের বেশি মানুষ ইতোমধ্যে শহর ত্যাগ করেছে। তিনি বাকিদেরও দ্রুত সিটি ছাড়ার আহ্বান জানান। তিনি দাবি করেছেন, এই স্থানান্তরের মাধ্যমে ইসরাইল হামাসকে পরাস্ত করতে চাচ্ছে এবং যারা স্থানান্তরিত হবে তাদের যথাযথ মানবিক সহায়তা দেওয়া হবে।
তবে ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা অভিযোগ করছেন, ইসরাইলের এই পদক্ষেপ মূলত গাজা সিটি খালি করার উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনি সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, এখনও শহরে ১২ লাখের বেশি মানুষ অবস্থান করছে। তাদের মতে, আল-মাওয়াসি এবং রাফাহ অঞ্চলে ১.৭ মিলিয়ন মানুষকে জোরপূর্বক স্থানান্তর করা হচ্ছে, যেখানে হাসপাতাল, অবকাঠামো এবং মৌলিক সেবার অভাব রয়েছে।
এই নির্দেশনা এমন সময় এসেছে যখন গাজা শহর বিমান হামলা ও স্থল অভিযানের তীব্র লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ইসরাইলের ‘গিডিয়নের চ্যারিয়টস ২’ নামের সামরিক অভিযান শুরু হয়েছে, যার উদ্দেশ্য গাজা সিটিকে পুরোপুরি দখল করা। এই অভিযান চলাকালীন ইসরাইলের ভেতরে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমালোচনা ছড়িয়েছে। সেনাদের এবং বন্দি রাখা ব্যক্তিদের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলার আশঙ্কা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গাজার সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ভয়াবহ। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে চলতি পর্যন্ত গাজায় ৬৪,৮০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে শিশু, নারী এবং বয়স্করা উল্লেখযোগ্য অংশ। সামরিক অভিযানে নগরের অধিকাংশ অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। খাদ্য, পানি ও চিকিৎসা সহায়তা কঠোর সংকটে পড়ে। ক্ষুধার্ত ও পানির অভাবের কারণে নগরের মানুষ বিপদের মুখে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, কমপক্ষে ৪১৩ জন মারা গেছে, যাদের মধ্যে ১৪৩ জন শিশু।
ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা বলছেন, দক্ষিণে স্থানান্তরিত এলাকা গুলোর অবকাঠামো ও হাসপাতাল সেবা পর্যাপ্ত নয়। তারা আশঙ্কা করছেন, সেখানকার জনসংখ্যার চাপ তীব্র মানবিক সংকট তৈরি করবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভ্যাকসিন, খাদ্য ও পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ দেখা দিতে পারে।

এই নির্দেশনা কার্যকর হওয়ার মধ্যেই গাজার নাগরিকরা ভয়, আতঙ্ক এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন। অনেকেই শহর ছেড়ে যাওয়ার পথ ধরে চললেও, নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পাওয়া অনেকের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশু, বৃদ্ধ এবং অসুস্থদের জন্য যাতায়াত ঝুঁকিপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও ইতিমধ্যেই এই স্থানান্তর ও অব্যাহত হামলার বিরুদ্ধে সতর্কতা জানিয়েছে। তারা বলছে, এই ধরনের জোরপূর্বক স্থানান্তর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের বিরুদ্ধ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে তৎপর হতে হবে।
ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী, স্থানান্তরের মাধ্যমে শহরের মানুষ নিরাপদে আশ্রয় নিতে পারবে। তবে ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা মনে করেন, এটি বাস্তবে সম্ভব নয়। আল-মাওয়াসি ও রাফাহ অঞ্চলে ইতোমধ্যেই ভাঙা অবকাঠামো, কম হাসপাতাল ও সীমিত পানি সরবরাহ রয়েছে। ফলে স্থানান্তরিতদের জন্য মানবিক সহায়তা দেওয়া প্রায় অসম্ভব।
সাম্প্রতিক বিমান হামলা ও স্থল অভিযানের কারণে গাজার অনেক পরিবার তাদের ঘরবাড়ি, সংরক্ষিত সম্পদ এবং জায়গা হারিয়েছে। অনেকেই বহু দিনের জীবনযাপন এবং সাংস্কৃতিক আবাস হারিয়েছেন। বিশেষ করে শিশুরা মানসিকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় গবেষক ও মানবাধিকার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, গাজা সিটি খালি করার এই পদক্ষেপের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। স্থানান্তরিতদের জন্য পর্যাপ্ত মানবিক সেবা না থাকলে, দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য সংকট এবং খাদ্য নিরাপত্তা আরও গুরুতর মাত্রায় পৌঁছাতে পারে।
সাম্প্রতিক গণমাধ্যম প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্থানান্তরিতদের জন্য সরকারি ও আন্তর্জাতিক সহায়তা কার্যকর হচ্ছে না। নিরাপদ আশ্রয়, পানি, খাদ্য এবং চিকিৎসা সেবা সংকটজনক। ফলে শিশু ও বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।
গাজা সিটির তাত্ক্ষণিক খালি করার নির্দেশ, বিমান হামলা ও স্থল অভিযানের ক্রমবর্ধমান তীব্রতা—সব মিলিয়ে ফিলিস্তিনিদের জন্য মানবিক বিপর্যয় তৈরি করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সংকটের প্রতি নজর দিচ্ছে, তবে বাস্তবে কার্যকর সহায়তা কতটা পৌঁছাবে তা এখনো অনিশ্চিত।
এই পরিস্থিতিতে শহরের ১২ লাখ মানুষ কোথায় যাবে, এবং তাদের বেঁচে থাকার নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত করা সম্ভব হবে—এটি বর্তমানে বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের অন্যতম প্রধান উদ্বেগ।