দারিদ্র্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে আজ এশিয়ার চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং একটি প্রভাবশালী বিশ্বশক্তি। সাড়ে সাত দশক আগে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠা, দেং জিয়াওপিংয়ের অর্থনৈতিক সংস্কার, শিল্পায়ন এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ—এই অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক কৌশলগুলো মিলে চীনকে একটি প্রযুক্তি, সামরিক ও কূটনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছে।
পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের চোখে চীনের উত্থান বড় মাথাব্যথার কারণ। এই প্রতিবেদনে আমরা চীনের এই উত্তরণের ইতিহাস, নীতি ও কৌশল নিয়ে বিস্তারিত জানব।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিপ্লবের প্রেক্ষাপট-
চীনের ইতিহাস ২০শ শতকের শুরুতেই রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভুগছিল। ১৯১১ সালে চিং রাজবংশের পতনের পর দেশটির রাজনৈতিক কাঠামো এবং সামাজিক বিন্যাস গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছিল, বিশেষ করে গ্রামীণ চীনে। শিক্ষার সুযোগ সীমিত এবং স্বাস্থ্যসেবা অপর্যাপ্ত হওয়ায় জনগণ সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত ছিল।
কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল থাকায় প্রাদেশিক নেতারা এবং স্থানীয় শক্তিগুলো অত্যধিক প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল। এর ফলে রাজনৈতিক বিভাজন, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়।
১৯২০-এর দশকে চীনের বড় শহর ও শিল্পকেন্দ্রে কুওমিনটাং বা কেএমটি দল প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। তবে গ্রামীণ এলাকায় ধীরে ধীরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) জনপ্রিয়তা অর্জন করে। শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে সমতার নীতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ, স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতা—এসবের মাধ্যমে সিসিপি জনসমর্থন বৃদ্ধি করে।

গৃহযুদ্ধ ও লং মার্চ-
১৯২৭ সালে চীনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। কেএমটি ও সিসিপির মধ্যে রাজনৈতিক ও সামরিক দ্বন্দ্ব গ্রামীণ জীবনে চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৫ সালে লংমার্চের মাধ্যমে সিসিপি নেতৃত্ব ও আদর্শ দৃঢ় হয় এবং বিপুল জনসমর্থন নিশ্চিত হয়। এই অভিযানের ফলে সিসিপি গ্রামীণ শক্তি আরও বৃদ্ধি পায়।
দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ (১৯৩৭–১৯৪৫) চলাকালীন সিসিপি জনগণের মধ্যে সমর্থন বৃদ্ধি করে। যুদ্ধের সময় গ্রামীণ চীনে জনগণের প্রায় ৯০ শতাংশের ওপর সিসিপির প্রভাব বিস্তার করে এবং সামাজিক নীতি বাস্তবায়নে সক্ষম হয়। এই সময় সিসিপি রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি সমন্বিত করতে সমর্থ হয়।
গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠা ও প্রশাসনিক পুনর্গঠন-
১ অক্টোবর ১৯৪৯, বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ সমবেত হয়। মাও সে তুং ঘোষণা দেন, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠিত হলো’। প্রেসিডেন্ট হিসেবে মাও এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চৌ এনলাই দায়িত্ব নেন। এটি চীনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
নতুন প্রশাসনিক কাঠামোতে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় কংগ্রেস, সামরিক ও বিচার বিভাগ অন্তর্ভুক্ত ছিল। সিসিপির লক্ষ্য ছিল কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা সমন্বয়, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, সামাজিক নীতি বাস্তবায়ন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।
প্রথম কর্মসূচির মধ্যে ভূমি সংস্কার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত সম্প্রসারণ, শিল্পায়ন এবং সামরিক সংহতি অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রায় ৫০ লাখ কৃষক নতুনভাবে জমি পান। প্রাথমিক শিল্পায়ন উদ্যোগে ১০০টি কারখানা নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত বা পুনর্গঠন করা হয়। গ্রামীণ স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সম্প্রসারণে প্রায় ১৫ হাজার নতুন বিদ্যালয় এবং ৫ হাজার স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপিত হয়।
সিসিপি সামাজিক নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন, শ্রমিক ও কৃষকের জীবনমান উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। স্কুলে নারীর অংশগ্রহণ প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং শিল্পায়ন কর্মসূচি গ্রামীণ ও শহুরে—উভয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে।
শিল্পায়নের ক্ষেত্রে তামা, লোহা, রাসায়নিক এবং যন্ত্রাংশ উৎপাদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শ্রমিক প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। সামরিক শিল্পও বৃদ্ধি পায়। নতুন অস্ত্র কারখানা এবং সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এটি চীনের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আত্মনির্ভরতা নিশ্চিত করে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও কূটনৈতিক কৌশল-
গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও দেশটির অবস্থান গুরুত্বপূর্ণভাবে পরিবর্তিত হয়। ১৯৫০ সালে সোভিয়েত-চীন বন্ধুত্ব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করে। চুক্তির মাধ্যমে প্রায় ৩০ কোটি ডলারের সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা চীন পায়।
পশ্চিমা দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, চীনের স্বীকৃতি দিতে বিলম্ব করে। বিপরীতে তাইওয়ানকে সমর্থন দেওয়া হয় এবং জাতিসংঘে চীনের আসন নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক হয়। তবে ১৯৫৫ সালে বান্দুং সম্মেলন চীনের কূটনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করে।
১৯৭১ সালে চীন জাতিসংঘে আসন পায় এবং সরকার বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃত হয়। ১৯৭২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের চীন সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন অধ্যায় সূচনা করে।

অর্থনৈতিক সংস্কার ও আধুনিকীকরণ-
১৯৭৮ সালে দেং জিয়াওপিং ক্ষমতায় এসে ‘সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ’ নীতি চালু করেন। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির পরিবর্তে বাজারভিত্তিক অর্থনীতি শুরু হয়। কৃষি খাতে ‘পারিবারিক দায়দায়িত্ব ব্যবস্থা’ চালু হয়। কৃষকরা উৎপাদনের একটি অংশ নিজেরা রাখেন এবং বাকি বাজারে বিক্রি করতে পারেন।
এই সংস্কারের ফলে খাদ্য উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৪ সালের মধ্যে চীন শস্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে কৃষকদের গড় আয় দ্বিগুণের বেশি হয়।
শিল্প ও বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) তৈরি করা হয়। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কর সুবিধা এবং অবকাঠামো উন্নয়নের সুযোগ দেওয়া হয়। ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে চীন বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের (এফডিআই) অন্যতম প্রধান গন্তব্য হয়ে ওঠে।
১৯৮০ থেকে ১৯৯০-এর দশকে চীনের অর্থনীতি বছরে ৯–১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়। লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার বাইরে আসে। তবে শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে বৈষম্যও দেখা দেয়। উদাহরণস্বরূপ, শেনজেন শহরের জনসংখ্যা ১৯৮০ সালে ৩০ হাজার ছিল। ১৯৯০ সালের মধ্যে তা ৩০ লাখে পৌঁছায়।
সামরিক ও প্রযুক্তিগত শক্তির উত্থান-
১৯৯০-এর দশক থেকে চীন সামরিক আধুনিকীকরণে জোর দেয়। পুরোনো অস্ত্রের পরিবর্তে উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধবিমান এবং নৌবাহিনী আধুনিক প্রযুক্তিতে সজ্জিত হয়। বার্ষিক ১০ শতাংশ হারে প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধি পায়।
চীন প্রথমবারের মতো বিমানবাহী রণতরী তৈরি করে। ২০১২ সালে লিয়াওনিং রণতরী নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়। পাশাপাশি সাইবার যুদ্ধ এবং মহাকাশ কর্মসূচিতেও ব্যাপক বিনিয়োগ করা হয়। ২০০৩ সালে চীন প্রথমবারের মতো নিজস্ব নভোচারীকে মহাকাশে পাঠায়। ২০০৮ সালে চীনা মহাকাশচারীরা প্রথমবার মহাশূন্যে হেঁটে যান।
প্রযুক্তি খাতেও চীন বিপুল অগ্রগতি করে। হুয়াওয়ে, লেনোভো, আলিবাবা ও টেনসেন্ট আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতা শুরু করে। গবেষণা ও উন্নয়নে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়, যা চীনকে প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করে।

বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ-
২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) ঘোষণা করেন। লক্ষ্য ছিল ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার মধ্যে বাণিজ্যিক ও অবকাঠামোগত সংযোগ জোরদার করা। রেলপথ, বন্দর, সড়ক ও জ্বালানি প্রকল্পে শত শত বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়।
২০২০ সালের মধ্যে বিআরআইতে ১৪০টির বেশি দেশ যুক্ত হয়। মোট বিনিয়োগ প্রায় ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। আফ্রিকায় চীনের সরাসরি বিনিয়োগ ২০০৫ সালে ৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২০ সালে ৫০ বিলিয়ন ডলারে বৃদ্ধি পায়।
বিআরআই প্রকল্পের মাধ্যমে চীন পাকিস্তানের গওয়াদার বন্দর, আফ্রিকার কেনিয়ার রেলপথ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দ্রুতগতির রেললাইন নির্মাণে বিনিয়োগ করে। এটি চীনকে বৈশ্বিক বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত করে।
প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেন, “বিশ্ব ভালো থাকলেই চীন ভালো থাকতে পারে। আর চীন ভালো করলে, বিশ্ব আরো ভালো হয়ে ওঠে।”
চীনের বৈশ্বিক প্রভাব-
চীনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার, শিল্পায়ন, কৃষক ও শ্রমিক ক্ষমতায়ন এবং আন্তর্জাতিক কৌশল দেশটিকে শক্তিশালী করেছে। চীনের এই উত্থান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় হুমকি। বেইজিং-এর বৈশ্বিক প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রকে বারবার পেছনে ঠেলে দিচ্ছে।
চীন শুধু দেশের ভিতরেই শক্তিশালী হয়নি, ধীরে ধীরে বিশ্বমঞ্চে নিজস্ব পরিচয় তৈরি করেছে। আজ এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক শক্তি—অর্থনীতি, প্রযুক্তি, সামরিক শক্তি ও কূটনীতিতে প্রভাবশালী। চীনের ইতিহাস শেখায়—পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও সঠিক নেতৃত্ব থাকলে বড় অর্জন সম্ভব।
- সূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, রয়টার্স, দ্য গার্ডিয়ান, দ্য হিস্ট্রি, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটান।

