হিটলার কি উন্মাদ ছিলেন? কবে থেকে ইহুদি-বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন? স্ত্রীর চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন যে পোষা কুকুরকে; তাকেও মেরে ফেলেন বিষ খাইয়ে; আসলে কি নিজেকে ছাড়া আর কাউকে কখনো ভালোবাসতেন হিটলার?
ইতিহাসের পাতা ওল্টালে অ্যাডলফ হিটলারের চেয়ে বড় কোনো মূর্তিমান আতঙ্ক বা অমীমাংসিত ধাঁধা হয়তো আর পাওয়া যাবে না। একজন ব্যর্থ চিত্রশিল্পী, কিছুটা অলস আর গড়পড়তা বুদ্ধির কেউ কীভাবে প্রায় একক হাতে গোটা বিশ্বকে দাঁড় করিয়ে দিলেন এক সর্বগ্রাসী ধ্বংসযজ্ঞের দ্বারপ্রান্তে?
হিটলার কি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন? তার শৈশব কি সত্যিই অসুখী ছিল? কোন মনস্তত্ত্ব তাকে চালিত করেছিল মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘাতের দিকে? এই জটিল প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে এখন আর ইয়ান কারশো’র প্রায় দুই হাজার পৃষ্ঠার বিশদ জীবনী ঘাঁটা প্রয়োজন পড়বে না।
মাত্র ১৭০ পৃষ্ঠার নতুন বই ‘হিটলার, ট্রুথস অ্যান্ড মিথস’ হিটলারকে নিয়ে বহু বছরের জমে থাকা কৌতুহল মেটানোর এক দারুণ সুযোগ এনে দিয়েছে। হিটলার সম্পর্কে যা কিছু জানার আগ্রহ, তার সবই মিলবে এই বইয়ে।
বইটি লিখেছেন ফরাসি ইতিহাসবিদ ক্লদ কুইতেল। বইটিতে হিটলারকে নিয়ে প্রায় ২০টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে। লেখক ক্লদ কুইতেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও নাৎসিবাদ নিয়ে গবেষণার জন্য সুপরিচিত। তিনি এর আগেও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন, যার মধ্যে রয়েছে ‘লা সেকোন্দে গুয়েরে মোন্দিয়ালে’, ‘ফাম দ্যান্স লা গুয়েরে ১৯৩৯-১৯৪৫’ এবং ‘টাউট সুর মাইন কাম্ফ’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও নাৎসিবাদ নিয়ে দীর্ঘদিনের গবেষক ক্লদ কুইতেল হিটলারকে নিয়ে প্রায় ২০টি জরুরি প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন তার বইয়ে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, হিটলারকে নিয়ে নতুন করে আর কী-ই বা বলার থাকতে পারে?
এই প্রশ্নের জবাবে তিনি লিখেন, ‘এই বইটির উদ্দেশ্য হিটলারের জীবনীর বিতর্কিত বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা।’ তিনি এখানে নাৎসিবাদ, ইহুদি গণহত্যা বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা করেননি, বরং হিটলারের ব্যক্তিত্ব ও মানসিকতার চালিকাশক্তি উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন। একই সঙ্গে হিটলারকে নিয়ে প্রচলিত কিছু ধারণাকেও তিনি খণ্ডন করেছেন।
হিটলারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী, ব্যক্তিগত সচিব ও সেনাপতিদের স্মৃতিকথা ও ডায়েরির ওপর ভিত্তি করে কুইতেল দেখিয়েছেন, কীভাবে ‘চির আলস্যে ডুবে থাকা’ এবং সাধারণ বুদ্ধিমত্তার একজন মানুষ তৃতীয় রাইখের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে উঠেছিলেন।

বাবার স্নেহের অভাব অবশ্য সুদে-আসলে পুষিয়ে দিয়েছিলেন তার মা। মায়ের আদরেই বড় হয়েছিলেন হিটলার। নিজের আত্মজীবনী ‘মাইন কাম্ফ’-এও মায়ের আদরে আলস্যে কাটানো শৈশবকে ‘জীবনের সেরা বছর’ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তার জীবনের মোড় ঘুরে যায় ভিয়েনার আর্টস একাডেমিতে ভর্তি হতে না পারা এবং সেই সাথে স্তন ক্যান্সারে মায়ের মৃত্যুর পর। লেখকের মতে, হিটলারের শৈশবকে কোনোভাবেই অসুখী বলা যায় না, তবে হিটলারের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের পেছনে মূল কারণ ছিল ‘বাস্তবতার সঙ্গে সংযোগ হারানো এক শিশুর অলসতা ও দিবাস্বপ্ন দেখার প্রবণতা’।
হিটলার কি শুরু থেকেই ইহুদি-বিদ্বেষী ছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তরে লেখক আঙুল তোলেন ভিয়েনায় কাটানো হিটলারের দুর্বিষহ জীবনের দিকে। সেই সময়ে তিনি জাতীয়তাবাদী ও বর্ণবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যান। তখনই ‘সংস্কৃতি ও জ্ঞানশূন্য এবং সীমিত বুদ্ধির এই ব্যক্তি’ তখন ইহুদি বিদ্বেষের ‘বিষাক্ত অলীক কল্পনায়’ নিজেকে সঁপে দেন। লেখকের মতে, কৈশোরের কিছু সময় বাদ দিলে হিটলার বরাবরই ইহুদি-বিদ্বেষী ছিলেন, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও গভীর ও অপরিবর্তনীয় হয়ে ওঠে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের বীরত্বের দাবি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কুইতেল। তিনি দেখিয়েছেন, হিটলার একজন স্টাফ কুরিয়ার হিসেবে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন, যা তাকে যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে দূরে রেখেছিল। তবে পদক বিতরণকারী কর্মকর্তাদের কাছাকাছি থাকার সুবাদেই জুটে গিয়েছিল আয়রন ক্রস ফার্স্ট ক্লাস পদকটি।

তার সেই বিখ্যাত বাগ্মিতাও নাকি ছিল পুরোপুরি সাজানো। প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি, এমনকি সেই নাৎসি স্যালুটটিও ছিল আয়নার সামনে বারবার অনুশীলন করা। তিনি এমন শ্রোতাদের সামনেই জ্বালাময়ী ভাষণ দিতেন, যারা আগে থেকেই তার কথা শোনার জন্য মুখিয়ে থাকত।
কুইতেলের মতে, হিটলারের ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ একদিকে যেমন অপ্রতিরাধ্য ছিল, তেমনই প্রতিরোধযোগ্যও ছিল। ফরাসিরা হিটলারের এই ধরনের বাগ্মিতায় দ্রুতই বিরক্ত হয়ে যেত। তার ক্যারিশমা সবার ওপর কাজ করত না। অনেকেই তাকে ‘মৃগীরোগীর মতো অঙ্গভঙ্গি’ করা একজন নগণ্য ব্যক্তি হিসেবেই দেখতেন।
হিটলারের ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু ছিল কি না, এ বিষয়ে কুইতেল ইতিহাসবিদ ইয়ান কারশ’র সঙ্গে একমত। তিনি লিখেছেন, ‘তার জীবন থেকে রাজনৈতিক অংশটুকু বাদ দিলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।’ আল্পস পর্বতমালার ওপর তার বিলাসবহুল বাংলো বার্গহফে আয়োজিত সান্ধ্যকালীন আসরগুলো ছিল মারাত্মক একঘেয়ে।
হিটলার চলচ্চিত্র পছন্দ করতেন। তবে তিনি বিড়াল পছন্দ করতেন না, কারণ তার মতে বিড়াল পাখি মেরে ফেলে! তার পছন্দ ছিল কুকুর। যদিও তার প্রিয় কুকুর ব্লন্ডিকে যেভাবে তিনি সায়ানাইড ক্যাপসুলের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য বিষ প্রয়োগ করে মেরে ফেলেছিলেন, তা তার স্নেহ-মমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করে। বলা হয়ে থাকে, ফুয়েরারবাঙ্কারে হিটলার ইভা ব্রাউনের চেয়ে ব্লন্ডির জন্য বেশি কেঁদেছিলেন।
হিটলার শারীরিকভাবে অক্ষম ছিলেন কি না—এই বহু আলোচিত প্রশ্নের বিষয়ে কুইতেল উল্লেখ করেছেন, এটা প্রায় নিশ্চিত যে হিটলার ২৪ বছর বয়সে ভিয়েনা ছাড়ার সময় পর্যন্ত ‘কোনো নারী বা পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়াননি।’ তবে, তিনি স্বল্পবসনা মেয়েদের ক্যাবারে শো দেখতে পছন্দ করতেন। পরবর্তী জীবনে, তিনি মধ্যবয়সী নারীদের সঙ্গে প্লেটোনিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন, যারা তাকে আগলে রাখতেন।

কুইতেলের মতে, হিটলারের কোনো শৈল্পিক প্রতিভা ছিল না। হিটলার জার্মানিতে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার কোনো উন্নতি করেননি—শ্রমিক শ্রেণি তাদের সমস্ত অধিকার হারিয়েছিল, বিশেষ করে যাদের রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছিল, তাদের কথা তো বলাই বাহুল্য। নারীরাও সমাজে তাদের অবস্থান হারিয়েছিল। নাৎসি তাত্ত্বিক রোজেনবার্গ বলেছিলেন, নারীদের ‘মুক্তি থেকে মুক্তি দিতে হবে’।
কুইতেল আরও বর্ণনা করেছেন, কীভাবে হিটলার নাৎসিদের ‘ইউথেনেশিয়া’ বা স্বস্তি-মৃত্যু কর্মসূচির বিষয়ে জার্মান গির্জাগুলোর কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিলেন, যদিও তিনি গির্জাগুলোকে ঘৃণা করতেন। আর হিটলারকে নিয়ে অনেক কিছু লেখা হলেও, তার ওপর সরাসরি আক্রমণ হয়েছিল মাত্র দুবার—১৯৩৯ সালের ৮ নভেম্বর মিউনিখের এক বিয়ার হলে এবং ১৯৪৪ সালের ২০ জুলাই স্টাফেনবার্গের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে।
ব্রিটিশরা কেন রোমেলকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল এবং হাইড্রিককে হত্যা করতে সফলও হয়েছিল, কিন্তু হিটলারকে হত্যার চেষ্টা করেনি? এর একটি কারণ হতে পারে যে, হিটলার একজন অত্যন্ত অদক্ষ রণকৌশলবিদ ছিলেন এবং মিত্রশক্তির জন্য তাকে ক্ষমতায় রাখাই সুবিধাজনক ছিল।
তার বড় ভুলগুলোর মধ্যে ছিল রাশিয়া আক্রমণ এবং ডানকার্কের ঘটনা। ডানকার্কে তিনি সামরিক কৌশলের চেয়ে রাজনৈতিক কৌশলকে—অর্থাৎ তার জেনারেলদের অতিরিক্ত খ্যাতি না দেওয়াকে—বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তবে সবশেষে কুইতেল স্বীকার করেছেন, জার্মানির পক্ষে ওই যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব ছিল না।
হিটলার কি উন্মাদ ছিলেন? ইতিহাসবিদ ক্লদ কুইতেলের মতে, ঠিক উন্মাদ না হলেও, তিনি এক সমান্তরাল বাস্তবতায় বাস করতেন এবং বাস্তব পৃথিবীকে অস্বীকার করতেন। অবশ্য, এমনটা অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটে, কিন্তু তার ফল পোল্যান্ড আক্রমণের মতো ভয়াবহ হয় না।
হিটলারের হিস্টিরিয়া বা তীব্র আবেগপ্রবণতাও ছিল, যা তার মানসিক বিকারের ইঙ্গিত দেয়। এর একটি বড় প্রমাণ পাওয়া যায় যখন এসএস জেনারেল ফেলিক্স স্টেইনারের সেনাবাহিনী অবরুদ্ধ বার্লিনকে মুক্ত করতে ব্যর্থ হয়। জীবনের শেষ দিকে তিনি প্রচুর মাদকও গ্রহণ করতেন।
শেষমেষ কুইতেল এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, হিটলারের ব্যক্তিত্ব ছিল ‘প্যারানয়েড’ বা সন্দেহবাতিক প্রকৃতির, যদিও তিনি কী করছেন, সে সম্পর্কে নিঃসন্দেহে সচেতন ছিলেন। পারমাণবিক বোমা প্রসঙ্গে বইটিতে বলা হয়, সৌভাগ্যবশত, এই বোমার কার্যকারিতা তাকে সঠিকভাবে বোঝানো হয়নি!
সূত্র: হিটলার / বিশ্বযুদ্ধ / মাইন কাম্ফ / হিটলার, ট্রুথস অ্যান্ড মিথস/ টিবিএস