লাখ লাখ ফিলিস্তিনির রক্ত যাঁর হাতে, তাঁর আবার ‘মান-অপমান’। তবু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মঞ্চ বলে কথা। সেদিন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বক্তৃতা শুরু করতেই একের পর এক প্রতিনিধি ওয়াকআউট করেন। মুহূর্তেই সভাকক্ষ প্রায় ফাঁকা হয়ে পড়ে। ‘গাজার কসাই’ নামে কুখ্যাত নেতানিয়াহু তখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে রইলেন অচঞ্চল মুখে। মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালেন, যেন কিছুই হয়নি। তবু তাঁর অস্বস্তি চোখ এড়ায়নি কারও।
এই অবস্থায় নিজের ‘অপমান’ ঢাকতে তিনি যা করলেন, তা তাঁর পুরোনো রাজনীতিক কৌশলেরই পুনরাবৃত্তি। গত ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে নেতানিয়াহু বলেন, “অনেক বিশ্বনেতা প্রকাশ্যে আমাদের নিন্দা করেন, কিন্তু গোপনে আমাদের ধন্যবাদ জানান।”
এ বক্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া তোলে—সত্যিই কি কেউ গোপনে ইসরায়েলকে প্রশংসা করছে, নাকি এটি কেবল নেতানিয়াহুর বাগ্মিতার ফাঁদ?
নেতানিয়াহু তাঁর দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ দেননি। কোন কোন নেতা এমন ‘দ্বিচারী’ আচরণ করেন, সেটাও উল্লেখ করেননি। ফলে বক্তব্যটির সত্যতা যাচাই করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে প্রায় চার দশকের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এই নেতার কাছে অপমান ঢাকার কৌশল নতুন কিছু নয়। যাঁরা ওয়াকআউট করেছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যেই হয়তো এই মন্তব্য করে তিনি পাল্টা আঘাত হানতে চেয়েছেন।

এতে তিনি এক ঢিলে দুই পাখি মারেন—প্রথমত, ওয়াকআউটকারী নেতাদের নৈতিক অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ করেন; দ্বিতীয়ত, আলোচনার কেন্দ্র নিজের ‘অপমান’ থেকে সরিয়ে নিয়ে যান তাঁর কথার দিকে। এতে ওয়াকআউটের বিষয়টি আড়ালে পড়ে যায়, আলোচনায় আসে নেতানিয়াহুর বাগ্মিতা।
এই কৌশল তাঁর কাছে পুরোনো অস্ত্র। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে নেতানিয়াহু বারবার দেখিয়েছেন, কীভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে ফেরাতে হয়। সমালোচক, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কিংবা এমনকি বিচারপতিদের বিরুদ্ধেও তিনি একই পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন—আক্রমণাত্মক বক্তব্য, কৌশলী রেটোরিক, ও আবেগপ্রবণ বয়ানের মাধ্যমে।
গবেষকেরা তাঁর জাতিসংঘে দেওয়া বক্তৃতাগুলোর বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন, কীভাবে তিনি নিজের ভাবমূর্তি ইতিবাচকভাবে তুলে ধরতে, জনমত নিয়ন্ত্রণে আনতে ও বিরোধীদের বিভক্ত করতে শব্দ ও প্রতীক ব্যবহার করেন।
তবে নেতানিয়াহুর বক্তব্য কেবল কৌশল নয়, বরং মিথ্যার আশ্রয় নেওয়ার পুরোনো অভ্যাসেরই ধারাবাহিকতা। বিশেষত ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে তিনি একাধিকবার বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন বলে আন্তর্জাতিক গবেষণায় উঠে এসেছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলের হামলা শুরু হয়, যার দুই বছর পূর্ণ হলো আজ মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর ২০২৫)। এই দুই বছরে গাজা উপত্যকা পরিণত হয়েছে এক ধ্বংসস্তূপে।

জাতিসংঘের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় ৬৭ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত এবং প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার আহত হয়েছেন। লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন।
জাতিসংঘের এক স্বাধীন তদন্ত প্রতিবেদনে সম্প্রতি উল্লেখ করা হয়েছে, গাজায় ইসরায়েল কার্যত জাতিগত নিধন চালাচ্ছে, যার দায় প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুসহ দেশটির শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর বর্তায়। এই রিপোর্ট প্রকাশের পর থেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসরায়েল কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে। এমনকি তাদের পুরোনো মিত্র দেশগুলোর মধ্যেও সমর্থন দ্রুত কমতে শুরু করে।
গাজায় রক্তপাত ও মানবিক বিপর্যয় চলতে থাকায় এখন অনেক পশ্চিমা দেশ ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডার মতো প্রভাবশালী দেশগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে নেতানিয়াহু আগের চেয়ে আরো বেশি বৈশ্বিক চাপে পড়েছেন। এই চাপে সামাল দিতে তাঁর হাতিয়ার এখন রেটোরিক, অর্থাৎ বাগ্মিতার ব্যবহার।
তবে জাতিসংঘে দেওয়া তাঁর বক্তব্য কেবল কথার খেলা হিসেবে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও রাজনীতিতে গোপন যোগাযোগের নজির অসংখ্য। প্রায়শই রাষ্ট্রগুলো প্রকাশ্যে একরকম অবস্থান নেয়, কিন্তু পর্দার আড়ালে করে ভিন্নরকম সমর্থন বা সহযোগিতা। তাই নেতানিয়াহুর দাবি একেবারে মিথ্যা বলেও ধোপে টেকে না।

এই বাস্তবতার ইঙ্গিত মেলে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম চ্যানেল ৪-এর এক সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে। সেখানে দেখা যায়, গাজায় চলমান গণহত্যার মাঝেই ২০২৫ সালের আগস্টে যুক্তরাজ্য ইসরায়েলে পাঠিয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার বুলেট। শুধু তাই নয়, একই মাসে ট্যাংক, রাইফেল, ক্ষেপণাস্ত্র, বিস্ফোরকসহ নানা সামরিক যন্ত্রাংশের বড় চালানও গেছে ইসরায়েলে। অথচ যুক্তরাজ্য প্রকাশ্যে ইসরায়েলের সমালোচনা করছে এবং ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে দেশটি ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানির ২৯টি লাইসেন্স স্থগিত করেছিল, যুক্তি ছিল—এসব অস্ত্র আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের লঙ্ঘনে ব্যবহৃত হতে পারে। তবু আজও প্রায় ৩৫০টি রপ্তানি লাইসেন্স সক্রিয় রয়েছে, যার মধ্যে ১৬০টির বেশি সরাসরি সামরিক পণ্য হিসেবে চিহ্নিত। এই দ্বৈত অবস্থানই নেতানিয়াহুর বক্তব্যকে কিছুটা প্রাসঙ্গিক করে তোলে।
এই বৈপরীত্যের মধ্যেই গত ২৯ সেপ্টেম্বর গাজা যুদ্ধ বন্ধে ২০ দফা পরিকল্পনা ঘোষণা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি তা ঘোষণা করেন নেতানিয়াহুকে পাশে রেখেই। কার্যত ইসরায়েলের স্বার্থরক্ষায় নির্মিত এই পরিকল্পনা তড়িঘড়ি করে অনুমোদন দিয়েছে মুসলিম বিশ্বের কয়েকটি প্রভাবশালী দেশ।
সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট মনিটরে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে ইতিহাসবিদ ও ফিলিস্তিনবিষয়ক লেখক হাসান বোখারি এই পদক্ষেপকে ফিলিস্তিনের প্রতি ভয়াবহ বিশ্বাসঘাতকতা বলে আখ্যা দিয়েছেন।
তাঁর মতে, এই দেশগুলো ইসরায়েলের বর্বরতাকে আড়াল করতে এবং ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকে দুর্বল করতে ভূমিকা রাখছে। ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য লড়াইকে ‘সন্ত্রাস’ হিসেবে চিত্রিত করার প্রচেষ্টা জোরদার হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে নেতানিয়াহুর বক্তব্যের তাৎপর্য আরো স্পষ্ট হয়। প্রকাশ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়ে, কিন্তু পর্দার আড়ালে অস্ত্র বিক্রি, গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ বা বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখা—এসব কার্যক্রমকেই এক অর্থে ‘গোপন ধন্যবাদ’ বলা যায়। জাতিসংঘের মঞ্চে নেতানিয়াহু হয়তো সেই ধন্যবাদের কথাই তুলে ধরেছেন, কৌশলে নিজের ‘অপমান’ ঢেকে দিয়েছেন।
নেতানিয়াহুর এই রেটোরিক তাই একই সঙ্গে আত্মরক্ষার কৌশল, রাজনৈতিক বার্তা এবং বৈশ্বিক বিভাজনের প্রতীক। বক্তৃতার পর ওয়াকআউটের ভিডিও যতবার প্রচারিত হয়েছে, ততবারই তাঁর বক্তব্যও শোনা গেছে—যা তিনি চেয়েছিলেন ঠিক সেটাই ঘটেছে। সমালোচনার কেন্দ্রে রইলেন না তিনি, বরং আলোচনায় স্থান পেল তাঁর বলা কথাগুলো।
অবশেষে বলা যায়, নেতানিয়াহুর বক্তব্যের সত্যতা নির্ভর করছে দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। তথ্য-প্রমাণ ছাড়া সেটিকে নিঃসন্দেহে সত্য বলা যায় না, তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির গোপন চুক্তি ও দ্বিচারিতার ইতিহাস বিবেচনায় একে পুরোপুরি মিথ্যাও বলা কঠিন।
হয়তো এ কারণেই তাঁর বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা—যে বাস্তবতায় নৈতিকতার চেয়ে কৌশলই বেশি প্রভাবশালী।
তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, মিডল ইস্ট মনিটর, দ্য গার্ডিয়ান, দ্য নিউইয়র্কার, ফোর্বস, রয়টার্স।