মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে এখন আগুন জ্বলছে—গাজার শিশুরা মাটির নিচে ঘুমোচ্ছে, আর বিশ্বনেতারা একের পর এক বিবৃতি দিচ্ছেন। কিন্তু এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সময় দু’জন পুরোনো খেলোয়াড়—রাশিয়া ও চীন—অদ্ভুতভাবে নীরব।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজার সীমান্তে হামাস ও মিত্র সংগঠনগুলো ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে প্রবল হামলা চালায়। এর প্রতিশোধে তেল আবিব যে গণবিধ্বংসী অভিযান শুরু করে, তা আজও চলছে—হাসপাতাল, স্কুল, ও শরণার্থী ক্যাম্পে পড়ছে বোমা।
এই অমানবিক হত্যাযজ্ঞ বন্ধে রাশিয়া কিংবা চীনের কাছ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। এমনকি মিশরের শার্ম আল-শেখে আয়োজিত গাজা শান্তি সম্মেলনেও তাদের উপস্থিতি ছিল না।
একসময় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বড় বড় সিদ্ধান্তের পেছনে যাদের ছায়া থাকত, সেই দুই পরাশক্তি এখন যেন কেবল আসন দখল করেই সন্তুষ্ট। প্রশ্ন উঠছে—তারা কি বিশ্বশান্তির দায়িত্ব ভুলে গেছে, নাকি নিজেদের তৈরি সংকটেই বন্দী হয়ে পড়েছে?
রাশিয়া-চীন ঘনিষ্ঠতার প্রতীক হয়ে উঠেছেন শি জিনপিং ও ভ্লাদিমির পুতিন। তবে এই বন্ধুত্ব এখন বিশ্বমঞ্চে অনেকেরই মাথাব্যথার কারণ।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা শান্তি পরিকল্পনা প্রকাশের পর রাশিয়া ও চীন আনুষ্ঠানিকভাবে সেটিকে “স্বাগত” জানায়।
রাশিয়ার মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, “আমরা চাই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হোক।”
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গুও জিয়াকুনও বলেন, “চীন ইসরায়েল-ফিলিস্তিন উত্তেজনা কমাতে সব ধরনের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে।”
কিন্তু বাস্তবে এই মন্তব্যগুলো ছিল নিছক আনুষ্ঠানিকতা—কোনো কার্যকর উদ্যোগ বা দৃঢ় কূটনৈতিক ভূমিকা নেওয়া হয়নি।
১৩ অক্টোবর মিশরের শার্ম আল-শেখে অনুষ্ঠিত হয় গাজা শান্তি সম্মেলন, যেখানে সভাপতিত্ব করেন ট্রাম্প ও মিশরের প্রেসিডেন্ট সিসি। ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাখোঁ, ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারসহ ২০টিরও বেশি দেশের শীর্ষ নেতা উপস্থিত ছিলেন।
কিন্তু রাশিয়া ও চীন—দুই পরাশক্তিকেই দেখা যায়নি।
রেডিও ফ্রি ইউরোপের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার প্রভাব এতটাই কমে গেছে যে মিশর তাদের আমন্ত্রণই জানায়নি।
সিরিয়ায় আসাদ সরকারের প্রতি মস্কোর একপাক্ষিক সমর্থন, ইউক্রেন দখল, এবং আন্তর্জাতিক আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা—সব মিলিয়ে রাশিয়া এখন অনেক দেশের কাছেই অবিশ্বস্ত ও আগ্রাসী শক্তি হিসেবে বিবেচিত।
অন্যদিকে, চীনের অবস্থান আরও জটিল। একদিকে তারা রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র; অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্কযুদ্ধ ও তাইওয়ান ইস্যুতে উত্তেজনা তুঙ্গে।
গাজা যুদ্ধ নিয়ে চীনের প্রতিক্রিয়া ছিল একেবারেই নিরাপদ ও কূটনৈতিক। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-মনিটর জানিয়েছে, গাজা যুদ্ধের প্রভাবে লোহিত সাগরের বাণিজ্যপথ ব্যাহত হওয়ায় চীনের বাণিজ্যিক স্বার্থ বড় ক্ষতির মুখে, কিন্তু বেইজিং প্রকাশ্যে কোনো ভূমিকা নেয়নি—বরং ‘সব কূল রক্ষা’ নীতিতে নীরব থেকেছে।
রাশিয়া-চীন দু’দেশই এখন নিজেদের তৈরি অস্থিরতায় জর্জরিত। রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন চালিয়ে নিজেই বৈশ্বিক বিচ্ছিন্নতায় পড়েছে,আর চীন তিব্বত, শিনজিয়াং ও তাইওয়ান ইস্যুতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বিশ্বজুড়ে সমালোচিত।
ফলে, বিশ্ব শান্তির প্রশ্নে তারা হয়তো আর আগের মতো নৈতিক নেতৃত্ব দিতে পারছে না—বরং নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত এক দ্বিধাগ্রস্ত শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
গাজা যখন আগুনে পুড়ছে, তখন বিশ্ব যদি সত্যিই শান্তির কথা বলে, তবে পরাশক্তিদেরও দায়িত্ব নিতে হবে।
রাশিয়া ও চীন যদি এই মানবিক বিপর্যয়ের সময়েও নীরব থাকে, তবে তারা একদিন বিশ্বশান্তির ইতিহাসে দর্শক হিসেবেই থেকে যাবে—নেতা হিসেবে নয়।