জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর। তার উত্তরসূরি কে হবেন, তা নিয়ে জাতিসংঘ ও বৈশ্বিক কূটনৈতিক অঙ্গনে ইতিমধ্যেই আলোচনা শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জোরালো তিনটি নাম সামনে এসেছে—চিলির সাবেক প্রেসিডেন্ট মিশেল ব্যাশেলে, আর্জেন্টিনার পরমাণু শক্তি সংস্থার মহাপরিচালক রাফায়েল মারিয়ানো গ্রসি এবং কোস্টারিকার সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান আঙ্কটাড মহাসচিব রেবেকা গ্রিনস্প্যান।
তবে আলোচনায় রয়েছে আরও কয়েকজনের নাম, যাদের মধ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসও রয়েছেন।
“রিউমার” বলছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় জানিয়েছে, জাতিসংঘ মহাসচিব পদে ড. ইউনূসের প্রার্থী হওয়ার খবরটি “রিউমার” বা গুজব। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, আনুষ্ঠানিক কিছু না থাকলেও শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে ড. ইউনূসের নাম বহুদিন ধরেই আলোচনায় আছে।
সূত্র জানিয়েছে, মহাসচিব নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হবে চলতি বছরের শেষ দিকে। সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশন থেকেই আলোচনার সূচনা হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে প্রার্থীদের নামও প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে।
তিন শীর্ষ প্রার্থী
জাতিসংঘের মহাসচিব নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে কাজ করা আন্তর্জাতিক প্রচারণাগুলোর তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত তিনজন প্রার্থী সবচেয়ে এগিয়ে।
১️⃣ মিশেল ব্যাশেলে – চিলির সাবেক প্রেসিডেন্ট ও জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার।
২️⃣ রাফায়েল মারিয়ানো গ্রসি – আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক।
৩️⃣ রেবেকা গ্রিনস্প্যান – কোস্টারিকার সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আঙ্কটাডের মহাসচিব।
ড. ইউনূসের নাম কেন আলোচনায়
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, স্থানীয় পর্যায়ে ড. ইউনূসের নাম মহাসচিব প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় এসেছে প্রায় ছয় মাস আগে। বিষয়টি এখনো সরকারি পর্যায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ওঠেনি, তবে জাতিসংঘের কিছু সূত্র তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে গুতেরেসের সঙ্গে তার সাক্ষাৎও হয়েছে, যদিও সেখানে মহাসচিব পদ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না তা নিশ্চিত নয়।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, “এটা সম্পূর্ণ রিউমার, কোনো ভিত্তি নেই।”
তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র মনে করে, আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ও ব্যক্তিত্বের বিচারে ড. ইউনূস এই পদের জন্য যোগ্য প্রার্থী। যদিও জাতিসংঘের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী এবার আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকা অঞ্চল থেকে মহাসচিব নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
একজন ঊর্ধ্বতন কূটনীতিক বলেন, “বান কি মুন ছিলেন এশিয়া থেকে, গুতেরেস ইউরোপ থেকে। এবার সুযোগটি হয়তো আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার। তবুও যদি এশিয়া থেকে কেউ মনোনয়ন পান, তাহলে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত হবে।”
মহাসচিব নির্বাচনের নিয়ম
জাতিসংঘ চার্টারের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নিরাপত্তা পরিষদের সুপারিশের ভিত্তিতে সাধারণ পরিষদ মহাসচিব নিয়োগ দেয়। সদস্য রাষ্ট্রগুলো প্রার্থীর নাম সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির কাছে আনুষ্ঠানিক চিঠির মাধ্যমে পাঠায়। এরপর নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে প্রার্থী সুপারিশ করে এবং সাধারণ পরিষদ গোপন ভোটাভুটির মাধ্যমে অনুমোদন দেয়।
নারী নেতৃত্বের সম্ভাবনা
এবারের নির্বাচনে স্বচ্ছ মনোনয়ন ও নারী প্রার্থীর অংশগ্রহণ গুরুত্ব পাচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, জাতিসংঘের ইতিহাসে এবারই প্রথমবার একজন নারী মহাসচিব নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
মিশেল ব্যাশেলে ইতোমধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারে তার অভিজ্ঞতা তাকে শক্ত অবস্থানে রেখেছে। লাতিন আমেরিকার দেশগুলো তার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হলে তার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি বলে মনে করা হচ্ছে।
রাফায়েল গ্রসি পারমাণবিক নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক দক্ষতায় প্রশংসিত, আর্জেন্টিনা ইতোমধ্যেই তার পক্ষে প্রচারণা শুরু করেছে।
রেবেকা গ্রিনস্প্যান অর্থনীতি ও লিঙ্গসমতায় দৃঢ় অবস্থানের জন্য আলোচনায় রয়েছেন, এবং কোস্টারিকা সরকার তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে মনোনয়ন দিয়েছে।
সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে আছেন—মেক্সিকোর সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলিসিয়া বার্সেনা, নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন, বলিভিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট ডাভিড চোকেউয়াঙ্কা, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাবেক সভাপতি মারিয়া ফার্নান্দা এস্পিনোসা, আইএমএফ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা, সার্বিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভুক ইয়েরেমিচ, জাতিসংঘের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল আমিনা মোহামেদ এবং বার্বাডোসের প্রধানমন্ত্রী মিয়া মটলি।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, “জাতিসংঘের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী মহাসচিব নির্বাচিত হন আঞ্চলিক ঘুর্ণন নীতিতে। এবার যদি আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার পালা হয়, তাহলে অন্য অঞ্চল থেকে নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা কম।”
বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী এই কূটনৈতিক পদ নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এখন বৈচিত্র্যময়। নারী নেতৃত্ব, আঞ্চলিক ভারসাম্য ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে এবার জাতিসংঘের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় লেখা হতে পারে। তবে বাংলাদেশের ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম যে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে, তা ইতোমধ্যেই স্পষ্ট।

