গাজায় অবশেষে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে, কিন্তু উপত্যকার মানুষের মুখে এখনো শান্তির হাসি ফেরেনি। যুদ্ধ থেমেছে ঠিকই, কিন্তু শুরু হয়েছে এক ভিন্ন দুঃস্বপ্ন—ইসরায়েলি বাহিনীর ফেলে যাওয়া অবিস্ফোরিত বোমার আতঙ্ক।
দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে টানা বোমা বর্ষণের পর গাজার বহু এলাকা এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত। আশ্রয়হারা মানুষ ও ত্রাণকর্মীরা ধীরে ধীরে নিজেদের ভাঙা ঘরে ফিরছেন, কিন্তু ফেরার সেই পথও এখন বিপদে ভরা। কারণ, ভাঙা দেয়ালের নিচে, ধুলোর স্তূপে কিংবা ধসে পড়া ভবনের পেছনে লুকিয়ে আছে হাজারো প্রাণঘাতী ফাঁদ।
জাতিসংঘের মাইন অ্যাকশন সার্ভিস (UNMAS) বলছে, গাজার ভেতরে কমপক্ষে ২০ হাজার অবিস্ফোরিত বিস্ফোরক ডিভাইস পড়ে আছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর এই বোমাগুলোই এখন নতুন করে প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে নিরীহ মানুষদের, বিশেষ করে শিশুদের।
আলজাজিরার এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এক ফিলিস্তিনি পরিবারের গল্প। যুদ্ধবিরতির পর তারা নিজ এলাকায় ফিরে এসে দেখতে পান, তাঁদের নতুন আশ্রয়ের পাশে পড়ে আছে একটি ইসরায়েলি সাঁজোয়া যান—যেটি কখন যে বিস্ফোরিত হয়, কেউ জানে না।
আরেক বাসিন্দা, আইমান কাদোরাহ, তাঁর পরিবারসহ এখন থাকছেন একটি বিশাল ধাতব কাঠামোর ওপর টাঙানো তাঁবুর নিচে—যা স্থানীয়ভাবে ‘বিস্ফোরক রোবট’ নামে পরিচিত। এই রোবটগুলো ইসরায়েল ব্যবহার করেছিল দূর থেকে ভবন ধ্বংস করার কাজে, আর এখন সেগুলোই সাধারণ মানুষের জীবনের জন্য ভয়ংকর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইউএনএমএএসের ফিলিস্তিন মিশনের প্রধান লুক ডেভিড আর্ভিং জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতির পর মানুষ যখন ধীরে ধীরে নিজেদের এলাকায় ফিরছে, তখনই এই বিস্ফোরণের ঝুঁকি মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে।
তিনি বলেন,
“যুদ্ধ শেষ হলেও এই বোমাগুলো যেন এখনো যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এগুলো প্রতিদিন সাধারণ মানুষকে হত্যা করছে, শিশুদের পঙ্গু করে দিচ্ছে।”
তাঁর ভাষায়, যত এলাকা পরিষ্কার হচ্ছে, ততই নতুন নতুন বিস্ফোরক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে—যা প্রমাণ করে বিপদের পরিমাণ কত ভয়াবহ।
গত দুই সপ্তাহেই গাজায় অন্তত কয়েকটি ঘটনায় অবিস্ফোরিত বোমা ফেটে শিশু আহত হয়েছে। এর মধ্যে দুজনের অবস্থা গুরুতর।
আর্ভিং বলেন, “এগুলো কেবল কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। বাস্তবে এমন শত শত ঘটনা ঘটছে—যেখানে শিশু কিংবা সাধারণ মানুষ হয় নিহত হচ্ছে, নয়তো আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করছে।”
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ৩২৮টি বিস্ফোরণের ঘটনায় মানুষ নিহত বা আহত হয়েছে, তবে জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি।
ইসরায়েলের হামলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত গাজা এখনো এক বিশাল খোলা কবরস্থানের মতো। যুদ্ধবিরতির পরও সেখানে চলছে এক ‘নীরব যুদ্ধ’—যুদ্ধ, যা অস্ত্রের নয়, অবশিষ্ট বিস্ফোরকের।
বেঁচে থাকা মানুষগুলো এখন প্রতিদিন আতঙ্কে কাটায়, জানে না পরের মুহূর্তে কোন খেলতে যাওয়া শিশু, কোন ত্রাণকর্মী, কিংবা কোন পথচারী হবে নতুন শিকার।

