সম্প্রতি মার্কিন রাজনীতির কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি—স্টিভ উইটকফ, জ্যারেড কুশনার, জেডি ভ্যান্স এবং মার্কো রুবিও—হঠাৎ ইসরায়েল সফরে হাজির হন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট: প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার যেন গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি থেকে পিছিয়ে না যায়।
এই সফর যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলবিরোধী নয়, বরং ইসরায়েলকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল। কারণ, তেল আবিবের চরম ডানপন্থি সরকার এখনও যুদ্ধ পুনরায় শুরু করার অজুহাত খুঁজছে। গাজায় ইতোমধ্যে ৬৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাই ওয়াশিংটনের এই আগমনকে কেউ কেউ বিদ্রূপ করে বলেছেন—“ইসরায়েলকে যেন শিশুর মতো দেখভাল করা হচ্ছে।”
সাবেক ইসরায়েলি কূটনীতিক অ্যালন পিঙ্কাসের ভাষায়, “ইসরায়েল আসলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্লায়েন্ট স্টেট।” যুক্তরাষ্ট্র থেকে তারা প্রতিবছর কোটি কোটি ডলার সাহায্য পায়, জাতিসংঘে ওয়াশিংটন তাদের হয়ে ভেটো দেয়, আবার সামরিকভাবেও ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সম্পর্কটা ‘বন্ধুত্বের’ চেয়ে বরং ‘নির্ভরতার’।
এবার ট্রাম্প প্রশাসন সেই নির্ভরতার দড়িটাই আরও টানছে। একে অনেকে বলছেন—ইসরায়েলকে নিজের ইচ্ছামতো চালানোর এক বিরল প্রচেষ্টা।
টাইম ম্যাগাজিনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্টভাবে বলেছেন, “আমি নেতানিয়াহুকে থামিয়েছিলাম। না হলে যুদ্ধ বছরের পর বছর চলত।”
তিনি আরও সতর্ক করেছেন, ইসরায়েল যদি অধিকৃত পশ্চিম তীর নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সব ধরনের সহায়তা বন্ধ করবে। যদিও ঠিক এর পরদিনই ইসরায়েলি পার্লামেন্ট সেই সংযুক্তি প্রস্তাবটি প্রাথমিকভাবে অনুমোদন দিয়েছে।
ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স পর্যন্ত একে “খুব বোকামি” বলে মন্তব্য করেছেন। এর পরই নেতানিয়াহু দপ্তর থেকে জানানো হয়—এই ভোট কেবল রাজনৈতিক প্ররোচনা।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সম্পর্ক সব সময়ই এক অসম ভারসাম্যের ওপর দাঁড়িয়ে। ওয়াশিংটন হলো নীতিনির্ধারক, আর তেল আবিব তার অনুসারী।
জো বাইডেনের সময় এই সম্পর্ক ছিল ‘বিয়ার হাগ’ ধরনের—অতিরিক্ত সহানুভূতি দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। কিন্তু ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে সম্পর্কের ধরন পাল্টেছে। এখন তিনি প্রকাশ্যেই নেতানিয়াহুকে চাপ দিচ্ছেন, এবং ফলও পাচ্ছেন।
চ্যাথাম হাউসের গবেষক ইয়োসি মেকেলবার্গের মতে, “মার্কিন প্রতিনিধিদল যতই অন্য কথা বলুক, তাদের এজেন্ডা পরিষ্কার—নেতানিয়াহুকে বলা হয়েছে কী করতে হবে।”
‘সিক্সটি মিনিটস’-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কুশনার বলেন, ট্রাম্প মনে করেছিলেন ইসরায়েল ‘নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে’। তাই এখন সময় এসেছে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার।
হোয়াইট হাউস বলছে, এই নীতি দুই দেশের সম্পর্ককেই আরও দৃঢ় করবে—যদিও বাস্তবে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য আরও স্পষ্ট করে তুলছে।
নেতানিয়াহুর সাবেক উপদেষ্টা মিচেল বারাক মনে করেন, মার্কিন প্রশাসন এখন ইসরায়েলের ক্ষেত্রে “ক্যারট অ্যান্ড স্টিক”—মানে পুরস্কার ও শাস্তি—দুই কৌশলই ব্যবহার করছে।
“যারা ইসরায়েল সফরে গেছেন, তারা আসলে স্টিক দেখাতে গেছেন,” বলেন বারাক। “অন্যদিকে, ক্যারট বা পুরস্কার হচ্ছে ট্রাম্পের রাজনৈতিক আশীর্বাদ—যেমন নেতানিয়াহুর দুর্নীতি মামলায় ছাড় পাওয়ার চেষ্টা।”
অক্টোবরের শুরুতে নেসেটে দেওয়া ভাষণে ট্রাম্প প্রকাশ্যে আহ্বান জানান, নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে চলমান দুর্নীতি মামলা থেকে যেন তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। বিশ্লেষকদের মতে, এটি ছিল একপ্রকার চুক্তির বার্তা—“আমার কথা মানলে, তোমার জন্য আমি ক্ষমা চাইব।”
তবে “ইসরায়েল এখন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে” এমন ধারণায় নেতানিয়াহু বেশ ক্ষুব্ধ। তার দাবি, “এক সপ্তাহে বলা হয়, ইসরায়েল আমেরিকাকে নিয়ন্ত্রণ করে। পরের সপ্তাহে বলা হয়, আমেরিকা ইসরায়েলকে নিয়ন্ত্রণ করে। দুইটাই হাস্যকর।”
কিন্তু বাস্তবতা বলছে অন্য কথা। গাজা যুদ্ধবিরতি, কাতারের প্রতি আনুষ্ঠানিক ক্ষমা, এমনকি ইরানের সঙ্গে ১২ দিনের সংঘাত শেষে হামলা বন্ধের সিদ্ধান্ত—সবই এসেছে ওয়াশিংটনের চাপের পরপরই।
অ্যালন পিঙ্কাসের ভাষায়, “ট্রাম্প প্রশাসন এখন ইসরায়েলকে তার সীমা মনে করিয়ে দিচ্ছে—তোমরা যতদূর যেতে পারবে, তার সীমানা আমরা ঠিক করব।”
এটাই বাস্তবতা: ইসরায়েল এখন যুক্তরাষ্ট্রের ছায়ায় বেঁচে থাকা এক মিত্র, যার স্বাধীনতা প্রতিদিন একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে।

