ইউরোফাইটার টাইফুন একটি অত্যাধুনিক মাল্টি-রোল ফাইটার বিমান, যা মূলত যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি এবং স্পেনের যৌথ উদ্যোগে ডিজাইন ও উন্নত করা হয়েছে। এটি ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে পশ্চিমী বায়ুসেনার মূল আক্রমণাত্মক ও প্রতিরক্ষামুখী ইউনিট হিসেবে ব্যবহার শুরু করে এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশে অভিগৃহীত হয়েছে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, ২০২৫ সালের ২৭ অক্টোবর, তুরস্ক ও যুক্তরাজ্য ২০টি ইউরোফাইটার টাইফুন বিমান কেনার জন্য একটি £৮ বিলিয়ন (প্রায় $১০.৭ বিলিয়ন) চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা যুক্তরাজ্যের ২০১৭ সালের পর প্রথম নতুন অর্ডার। (এপি)

টাইফুনের ডিজাইন মূলত উচ্চ গতি, তীব্র ম্যানুভারেবিলিটি এবং বহুমাধ্যমে কাজে লাগার ক্ষমতা—এই তিনটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে করা হয়েছে, যাতে এটি একদিকে আকাশ-থেকে-আকাশ লড়াইয়ে সক্ষম হয় এবং অন্যদিকে গ্রাউন্ড অ্যাটাক ও সমুদ্রভিত্তিক অপারেশনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
বিমানটির যান্ত্রিক কনফিগারেশন ও শক্তি সরবরাহ করে দুটি EJ200– অ্যাডভান্সড টার্বোফ্যান জেট ইঞ্জিন, যা টাইফুনকে উচ্চ ত্বরণ, সুপারক্রুজিং সম্ভাবনা (অর্থাৎ অতিরিক্ত বার্নার ছাড়া উচ্চ গতিতে ক্রুজে সক্ষমতা) এবং লম্বা অপারেশনাল রেঞ্জ দেয়। এই ইঞ্জিন দুটির সংমিশ্রণ বিমানটিকে দ্রুত উচ্চতা অর্জন, হঠাৎ কৌণিক পরিবর্তন করা এবং ক্ষেপণাস্ত্র বা আক্রমণের সময় ত্বরিত প্রতিক্রিয়া প্রদানে সহায়তা করে।
ডিজাইনেও ব্যবহৃত আছে একটি হালকা কিন্তু শক্তিশালী এয়ারফ্রেম এবং অ্যারোডাইনামিক্যালি দক্ষ নাকশা, যা ম্যানুভারেবিলিটি বাড়ায় এবং প্রতিরক্ষামুখী/আক্রমণাত্মক উভয় ধরণের অবস্থান থেকে কার্যকর গতি বজায় রাখতে সক্ষম করে।

টাইফুনের কার্যকারিতা নির্ভর করে তার উন্নত অ্যাভিয়নিক্স ও সেন্সর সেটের উপর। প্রধানত এতে একটি শক্তিশালী রাডার, ইনফ্রারেড সার্চ অ্যান্ড ট্র্যাকিং (IRST) সিস্টেম, উন্নতকম্পিউটার-ভিত্তিক ফ্লাইট কন্ট্রোল ও মিশন কম্পিউটার রয়েছে, যা পাইলটকে শত্রু সনাক্তকরণ, লক্ষ্য ট্র্যাকিং ও অস্ত্র ব্যবস্থাপনা করতে দ্রুত এবং নির্ভুল তথ্য দেয়। রাডার শত্রুবাহী বিমানের অবস্থান, গতিপথ এবং উদ্বায়ী হুমকি শনাক্ত করে; IRST অপটিক্যালভাবে তাপ-সিগনেচার ধরে শত্রুকে ‘চালান’ দেয়—বিশেষ করে রাডার-শিল্ডেড বা জ্যামিং-প্রচেষ্টার সময়। এসব সেন্সরের সমন্বয়ে টাইফুন সহজেই বহু-লক্ষ্য ট্র্যাকিং, কৌশলগত অগ্রাধিকার নির্ধারণ এবং রিয়েল-টাইম সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হয়।
অস্ত্রনির্ভর দিক থেকে টাইফুন একটি বহুমুখী বিমান; এটা একটি যুদ্ধবিমান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চ করে অন্যান্য বিমানকে লক্ষ্য বানাতে সক্ষম, বিমান-স্থল (শক্তিশালী অথবা লেজার-গাইডেড) বোমা এবং সংক্ষিপ্ত-দূরত্বের কামরাতে বন্দুক বহন করতে পারে। সাধারণ কনফিগারেশনে এয়ার-টু-এয়ার কামরায় অ্যাডভান্সড রেডার-গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র এবং শর্টার রেঞ্জ ইরো-মিসাইল ব্যবহার করা হয়, যা উচ্চ গতির লড়াইয়ে অত্যন্ত কার্যকর।

গ্রাউন্ড অ্যাটাকের জন্য লেজার-গাইডেড বোমা (পেভওয়ে-ধরনের) এবং স্মার্ট বোমার ব্যবহার করে নির্দিষ্ট স্থল লক্ষ্য নিখুঁতভাবে ধ্বংস করা যায়। এছাড়া টাইফুনের অর্গানিক গন (সাধারণত 27mm ক্যানন) আছে, যা কাছাকাছি লড়াই বা বিমান-বিমানের মধ্যে তীব্র দরকারে ব্যবহৃত হয়।
প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে টাইফুন কেবল শারীরিক ম্যানুভারিংয়ের ওপরই নির্ভর করে না; আধুনিক ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার (EW) সিস্টেম এবং কোরপাসিভ সিস্টেম এটিকে ক্ষেপণাস্ত্র এবং রাডার-নিযুক্ত শত্রু থেকে সুরক্ষা দেয়। EW ইউনিট রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি জ্যামিং, ইলেকট্রনিক সিগন্যাল ইন্টারফেয়ারেন্স এবং শত্রুর রাডার-সিগন্যালকে বিভ্রান্ত করে, যা শত্রু লক্ষ্য নির্ধারণ ও লক-অনকে কঠিন করে দেয়।
তাছাড়া চ্যাফ ও ফ্লেয়ার সিস্টেম শারীরিকভাবে হোমিং ক্ষেপণাস্ত্রকে বিভ্রান্ত করে, আর পাইলট কৌশলগত ম্যানুভারিং (উচ্চ-গতি, তীক্ষ্ণ বাঁক, উচ্চ-অবতরণ ইত্যাদি) ব্যবহার করে আক্রমণ এড়াতে সক্ষম হন। এসব একত্রে টাইফুনকে আধুনিক সেনাবাহিনীতে অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরক্ষামূলক প্ল্যাটফর্ম বানায়।

অপারেশনাল দিক থেকে টাইফুন বহু রকম মিশনে ব্যবহার করা যায়—পূর্বেই উল্লিখিত বায়ু আধিপত্য বজায় রাখা, শত্রু স্থল সামরিক ঘাঁটি আঘাত করা, সমুদ্র রণকৌশলে অংশগ্রহণ করা এবং বাগদত্ত জরুরী প্রতিক্রিয়া। এর মিশন-লোড আকারে পরিবর্তন করা যায়: একটি সাঙ্গ বাহিনী-বিচ্ছিন্ন কনফিগারেশন বা ভারি অস্ত্রভর্ৎসিত আক্রমণ-উপযোগী কনফিগারেশন। বহুজাতিক অপারেশন ক্ষেত্রেও টাইফুনের ডিজাইন এমনভাবে করা হয়েছে যে, বিভিন্ন দেশের কমান্ড ও কন্ট্রোল স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে ইনটিগ্রেট করা যায়—ফলস্বরূপ, নেটওয়ার্ক-সেন্ট্রিক অপারেশনেও এটি সুফল দেয়।
পরিশেষে, টাইফুনের মূল শক্তি হল তার ভবিষ্যত-রক্ষণশীল সক্ষমতা: প্ল্যাটফর্মটি ধারাবাহিকভাবে আপগ্রেডযোগ্য করা হয়েছে- যাতে সেন্সর, সফটওয়্যার ও আয়ুধ-ওপশনের পরিবর্তনের সাথে তাল মেলানো যায়। এ কারণে অনেক দেশই তাদের টাইফুন স্কোয়াড্রন সময়ে সময়ে নতুন সফটওয়্যার, উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র অথবা উন্নত সেন্সর যোগ করে আধুনিকীকরণ করে চলছে। এসব আপগ্রেড টাইফুনকে আগামী কয়েক দশকেও কার্যকর রাখার লক্ষ্য রাখে, ফলে এটি আজকের আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে ও ভবিষ্যৎ লড়াইগুলোতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে ধরা হয়।
তথ্যসংগ্রহ: এফ. আর. ইমরান

