ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি আবারও দম বন্ধ করা দূষণে ঢেকে গেছে। শহরের বাতাসে ঘন ধোঁয়াশা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সূর্যের আলো পর্যন্ত ঢেকে যাচ্ছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় মঙ্গলবার দিল্লি সরকার ও আইআইটি কানপুরের একদল বিজ্ঞানী মেঘে বৃষ্টি নামানোর (ক্লাউড সিডিং) পরীক্ষা চালায়। কিন্তু ৫৩ বছর পর পরিচালিত এই পরীক্ষাটি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে, কারণ আকাশে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা ছিল না।
বৃষ্টি নামাতে সাধারণত আকাশে ছোট ছোট কণিকা ছোড়া হয়—যেমন সিলভার আয়োডাইড বা সোডিয়াম ক্লোরাইড। এই কণাগুলো মেঘের ভেতর বরফের স্ফটিক তৈরি করে, যা থেকে ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টি হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হলেও বিশেষজ্ঞরা একে স্থায়ী সমাধান হিসেবে দেখেন না।
মঙ্গলবার দিল্লির আকাশে উড়ে যায় একটি সেসনা বিমান, যাতে সংযুক্ত ছিল বিশেষ ধরনের আগুনের ফ্লেয়ার—এর ভেতরে ছিল সিলভার আয়োডাইড ও সোডিয়াম ক্লোরাইড। পরিকল্পনা ছিল, এগুলো মেঘের ভেতরে ছড়িয়ে দিয়ে কৃত্রিমভাবে বৃষ্টি ঘটানো।
তবে আইআইটি কানপুরের দেওয়া বিবৃতিতে জানানো হয়, প্রত্যাশিত বৃষ্টি না হলেও বাতাসের দূষণমাত্রায় কিছুটা উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে। “পর্যাপ্ত আর্দ্রতা না থাকলেও পরীক্ষাটি ইঙ্গিত দেয়, ক্লাউড সিডিং পদ্ধতি সীমিত পর্যায়ে বায়ুর মান উন্নত করতে পারে,” বলা হয় বিবৃতিতে।
আইআইটি কানপুরের পরিচালক মণীন্দ্র আগরওয়াল বিবিসিকে বলেন, “বৃষ্টিই ছিল সাফল্যের মূল মাপকাঠি, আর সেটি হয়নি। মেঘে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা ছিল না। তবে আমরা ভবিষ্যতেও এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।” তিনি আরও জানান, আগামী কয়েক সপ্তাহে আর্দ্রতা বাড়লে পরীক্ষাটি আবারও করা হতে পারে।
গত দুই সপ্তাহ ধরে দিল্লির এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (AQI) ৩০০ থেকে ৪০০ এর মধ্যে ঘোরাফেরা করছে—যা স্বাভাবিক সীমার প্রায় ২০ গুণ বেশি। এর মানে শহরের বাতাসে সূক্ষ্ম ধূলিকণার ঘনত্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যা সহজেই ফুসফুসে জমে শ্বাসকষ্ট ও অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
এমন পরিস্থিতিতে শহরের রাস্তায় চলছে “স্মগ গান”—বড় ট্রাকের পেছন থেকে পানি ছিটিয়ে ধুলো দমন করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু তা সাময়িক স্বস্তি দিচ্ছে মাত্র।
ভারতে ক্লাউড সিডিং কোনো নতুন ধারণা নয়। দিল্লিতে প্রথম এ ধরনের পরীক্ষা হয়েছিল ১৯৫৭ সালে, এরপর ১৯৭২ সালে আরেকটি। তবে তখন উদ্দেশ্য ছিল খরা মোকাবিলা, বায়ু দূষণ নয়। এবারই প্রথমবারের মতো স্থানীয়ভাবে তৈরি এই প্রযুক্তি সরাসরি দূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহারের চেষ্টা হলো।
২০২৩ সালেও দিল্লি সরকার এমন একটি প্রকল্প নিতে চেয়েছিল, কিন্তু আদালতের অনুমোদন না মেলায় তা বাস্তবায়িত হয়নি। বিজ্ঞানীরা তখনই সতর্ক করেছিলেন—এই প্রক্রিয়া ব্যয়বহুল এবং সাফল্যের হার খুবই সীমিত।
জলবায়ু ও স্থায়িত্ববিষয়ক বিশেষজ্ঞ অবিনাশ মহান্তি বিবিসিকে বলেন, “এখনও পর্যন্ত পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই যে ক্লাউড সিডিং করে বাস্তবিকভাবে কতটা AQI কমানো যায়। তাছাড়া, এটি মূলত প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ—এর সীমাবদ্ধতা ও অজানা প্রভাব থাকবেই।”
বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এই প্রযুক্তির ফলাফল মিশ্র। চীন ২০০৮ সালের অলিম্পিকের আগে বৃষ্টি নিয়ন্ত্রণে সফলতার দাবি করেছিল, সেখানে রকেট, কামান ও ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছিল মেঘে রাসায়নিক ছড়াতে। তবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে গত বছর ভয়াবহ বন্যার পর প্রশ্ন উঠেছে—অতিরিক্ত ক্লাউড সিডিংই কি তার জন্য দায়ী ছিল?
দিল্লির বিজ্ঞানীরা আপাতত আশা হারাচ্ছেন না। শহরের আকাশে আর্দ্রতা বাড়লেই তারা আবারও মেঘে “বৃষ্টির বীজ” ছড়ানোর পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু মূল প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—যে শহরে প্রতিদিন কোটি মানুষের শ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে, সেখানে কৃত্রিম বৃষ্টি কি সত্যিই মুক্তির পথ হতে পারে?

