মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দীর্ঘস্থায়ী বাণিজ্যযুদ্ধের অবসান এখনো দূরের কথা। দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন কিছুটা কমানোর চেষ্টা চলছে বটে, কিন্তু তাতে বাস্তবে বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। বরং পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, কৌশলগত প্রজ্ঞা ও দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতির দিক থেকে চীনই এখন এই যুদ্ধে এগিয়ে আছে।
গত বৃহস্পতিবার দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দেখা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বৈঠকের উদ্যোগ আসে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকেই। আলোচনায় বাণিজ্যসহ নানা ইস্যু উঠে আসে, যার পর ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্ক ১০ শতাংশীয় পয়েন্ট কমাতে সম্মত হন। বিনিময়ে বেইজিং যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টানিল পাচার দমনে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার করে। তবুও কার্যকর গড় শুল্কহার এখনো ৪৭ শতাংশে রয়ে গেছে।সিএনএন
ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির শুরু থেকেই এই বাণিজ্যযুদ্ধের সূচনা। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত এটি কেবল আরও জটিল আকার নিয়েছে। প্রাথমিক ধাক্কায় চীনের প্রবৃদ্ধির গতি কিছুটা মন্থর হলেও- সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র তেমন কোনো স্পষ্ট সুবিধা আদায় করতে পারেনি। বরং সময়ের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে—চীন তার ক্ষতি পূরণে আরও বহুমাত্রিক ও কৌশলগত পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুর আগেই চীনের রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রে কমতে শুরু করেছিল। গত কয়েক মাসে সেই পতন আরও তীব্র হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ৩৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের একই মাসে ছিল ৪৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ মাত্র এক বছরে রপ্তানি কমেছে প্রায় ২৭ শতাংশ।
তবে এই পতনেও বেইজিং বিচলিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য কমলেও, বৈশ্বিক পরিসরে চীনের মোট রপ্তানি বেড়েছে ৬ দশমিক ১ শতাংশ। সেপ্টেম্বর মাসে আগের বছরের তুলনায় রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। কারণ স্পষ্ট—চীন তার বাজার বৈচিত্র্য বাড়িয়েছে। দেশটি শুধু নতুন রপ্তানি গন্তব্যই খুঁজে নিচ্ছে না, বরং আমদানির ক্ষেত্রেও বিকল্প উৎস তৈরি করছে। যুক্তরাষ্ট্রের জায়গায় লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে পণ্য আমদানি বাড়ানো হচ্ছে দ্রুতগতিতে।

বাণিজ্যযুদ্ধের একটি কেন্দ্রীয় ইস্যু হলো সয়াবিন। কৃষিপণ্যটি দুই দেশের সম্পর্কের একটি সূচক হিসেবেও বিবেচিত। একসময় যুক্তরাষ্ট্র ছিল চীনের অন্যতম সয়াবিন সরবরাহকারী, কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে সে আমদানি প্রায় বন্ধের পথে। সেপ্টেম্বরে তো চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এক দানা সয়াবিনও আমদানি করেনি—এমন ঘটনা বহু বছরের মধ্যে প্রথম। পরিবর্তে দেশটি ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে ব্যাপক হারে সয়াবিন কিনছে।
এই সময় আর্জেন্টিনা সরকার সাময়িকভাবে সয়াবিন রপ্তানির ওপর শুল্ক স্থগিত রাখে। সেই সুযোগে চীন দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশ থেকে প্রায় ১২ লাখ মেট্রিক টন সয়াবিন আমদানি করে। শি জিনপিং ও ট্রাম্পের বৈঠকের আগেই আন্তর্জাতিক বাজারে শিকাগো সয়াবিন ফিউচারস সূচক বেড়ে যায়, যা বাজারে প্রত্যাশিত উত্তাপের ইঙ্গিত দেয়।
বৈঠকের পর মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট জানান, চীন আবারও যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, এই মৌসুমে চীন ১ কোটি ২০ লাখ মেট্রিক টন সয়াবিন আমদানি করবে এবং আগামী তিন বছর গড়ে প্রতিবছর ২ কোটি ৫০ লাখ মেট্রিক টন করে ক্রয় অব্যাহত রাখবে।
তবে শুধু সয়াবিন নয়, গরুর মাংস নিয়েও দুই দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম রপ্তানি পণ্য গরুর মাংস, আর এত দিন চীন ছিল এর তৃতীয় বৃহত্তম ক্রেতা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে গরুর মাংস কেনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে।
মার্কিন কৃষি দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত চীন ৪৮১ মিলিয়ন ডলারের গরুর মাংস আমদানি করেছে। অথচ এই সময় যুক্তরাষ্ট্রের মোট রপ্তানির মাত্র ৮ শতাংশ এর মাধ্যমে গেছে চীনে। গত বছরের একই সময়ে এই হার ছিল ১৫ শতাংশ—অর্থাৎ আমদানি কমেছে প্রায় ৪৭ শতাংশ।
চীন এখানেও বিকল্প উৎস খুঁজে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গরুর মাংস আমদানির চুক্তি নবায়ন না হওয়ায় দেশটি এখন অস্ট্রেলিয়া ও আর্জেন্টিনা থেকে মাংস কেনা বাড়িয়েছে। চীনের শুল্ক প্রশাসনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে দেশটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে মাত্র ১১ মিলিয়ন ডলারের গরুর মাংস আমদানি করেছে, যেখানে গত বছরের একই মাসে আমদানির পরিমাণ ছিল ১১০ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরে আমদানি কমেছে প্রায় ৯০ শতাংশ।
এই প্রবণতা ইঙ্গিত দেয়—চীন কেবল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে লেনদেন কমাচ্ছে না, বরং তার অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতার কাঠামোই বদলে ফেলছে। এটি কৌশলগতভাবে এক দীর্ঘমেয়াদি রূপান্তর, যার মাধ্যমে চীন বৈশ্বিক বাণিজ্যের ভারসাম্য নিজের দিকে টানছে।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসন একদিকে শুল্কহার কিছুটা কমাচ্ছে, অন্যদিকে আমদানি–রপ্তানির ভারসাম্য ঠিক রাখতে পারছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব মার্কিন কৃষক ও নির্মাতাদের ওপর পড়ছে সবচেয়ে বেশি। সয়াবিন থেকে ইস্পাত—সব ক্ষেত্রেই বিকল্প বাজার হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
বাণিজ্যযুদ্ধের শুরুতে ট্রাম্পের লক্ষ্য ছিল চীনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন ফিরিয়ে আনা। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে উল্টোটা—চীনের শিল্প উৎপাদন ক্ষণিকের ধাক্কা সামলে এখন আরও বহুমুখী হয়ে উঠেছে। দেশটি কৌশলগতভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে নতুন সরবরাহ চেইন তৈরি করছে, যাতে মার্কিন বাজারে প্রবেশের বিকল্প পথ খোলা থাকে।
বিশ্লেষকদের মতে, বাণিজ্যযুদ্ধে চীনের সাফল্যের মূল কারণ এর অভিযোজন ক্ষমতা। রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল নেতৃত্ব, বৈচিত্র্যময় রপ্তানি বাজার এবং বৈশ্বিক জোট কৌশল—সব মিলিয়ে চীন এমন এক অবস্থানে পৌঁছেছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি পদক্ষেপের পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে দ্রুত ও কার্যকরভাবে।
অন্যদিকে, ট্রাম্প প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ চাপও কম নয়। কৃষিখাতের ক্ষতি, উৎপাদন খরচের বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক মিত্রদের সঙ্গে বাণিজ্য অনিশ্চয়তা—সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন রক্ষণাত্মক অবস্থায়। চীনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধ ঘোষণা করলেও- বাস্তবে এখন দেখা যাচ্ছে সেই যুদ্ধেই যুক্তরাষ্ট্রই ক্রমে পিছু হটছে।
সবশেষে বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের সাময়িক ছাড় ও কূটনৈতিক প্রয়াস সত্ত্বেও চীনের প্রতিক্রিয়া অনেক বেশি পরিণত। বেইজিং কেবল শুল্কনীতিতে নয়, কৌশলগত অর্থনীতিতেও নিজেকে এমনভাবে প্রস্তুত করেছে যে, বাণিজ্যযুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদি চাপ তাকে খুব একটা নড়াতে পারছে না।
ফলে এই মুহূর্তে বলা যায়—বাণিজ্যযুদ্ধের ময়দানে চীনই এখন এগিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান টিকিয়ে রাখতে পারছে না, আর বেইজিং নিজস্ব পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বৈশ্বিক বাণিজ্য কাঠামোয় তার প্রভাব আরও বিস্তৃত করছে।

