বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এখন এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। চীনের তৈরি এসওয়াই-৪০০ (SY-400) স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা এখন আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয়েছে সেনাবাহিনীর অস্ত্রভাণ্ডারে—যা শুধু একটি নতুন অস্ত্র সংগ্রহ নয়, বরং বাংলাদেশের সামরিক আধুনিকায়নের ইতিহাসে এক কৌশলগত মাইলফলক।
এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ এখন এমন এক সক্ষমতা অর্জন করেছে যা আগে কেবল কল্পনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল—দূরপাল্লায় নির্ভুলভাবে আঘাত হানার ক্ষমতা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা কাঠামো কেবল রক্ষামূলক অবস্থান থেকে সরে এসে এক সক্রিয় প্রতিরোধ শক্তিতে পরিণত হলো।
বাংলাদেশের এই উদ্যোগ আসে ফোর্সেস গোল ২০৩০-এর ধারাবাহিক অংশ হিসেবে, যেখানে লক্ষ্য হচ্ছে আধুনিক, গতিশীল এবং প্রযুক্তিনির্ভর সেনাবাহিনী গঠন করা।
এসওয়াই-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা প্রায় ২৮০ কিলোমিটার, যা বাংলাদেশকে সীমান্তের বহু দূরের সামরিক ঘাঁটি, রাডার স্টেশন বা কমান্ড সেন্টার লক্ষ্যবস্তু করার সক্ষমতা দেয়।
এর ফলে সেনাবাহিনী এখন আর কেবল সীমান্তরক্ষা বা নিকটবর্তী সহায়তা বাহিনী নয়—বরং দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত প্রেক্ষাপটে এক নির্ভুল আঘাত হানতে সক্ষম আঞ্চলিক শক্তি।
এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাটি তৈরি করেছে চায়না এরোস্পেস সায়েন্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি করপোরেশন (CASIC)।
প্রতিটি ৮×৮ ট্রান্সপোর্টার-ইরেক্টর-লঞ্চার (TEL) যান একসঙ্গে আটটি ক্ষেপণাস্ত্র বহন ও উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম, অর্থাৎ দ্রুত গতিতে একাধিক দিক থেকে আক্রমণ করা সম্ভব।
প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্রের দৈর্ঘ্য প্রায় ৬ মিটার, ওজন ৯০০ থেকে ১,৩০০ কিলোগ্রাম, এবং এতে ২০০–৩০০ কিলোগ্রাম ওজনের ওয়ারহেড বসানো যায়।
এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায় ব্যবহৃত হয় চীনের বেইডু স্যাটেলাইট ন্যাভিগেশন সিস্টেম ও ইনর্শিয়াল গাইডেন্স প্রযুক্তি, যা লক্ষ্যভেদে ৩০–৫০ মিটার পর্যন্ত নির্ভুলতা (CEP) নিশ্চিত করে—বিশ্বের অন্যতম সুনির্দিষ্ট স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এটি।
প্রয়োজনে এটি BP-12A ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে রূপান্তরিত হয়ে আরও দূরপাল্লার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে।
এটি Mach 5.5 (শব্দের সাড়ে পাঁচ গুণ) গতিতে চলতে পারে এবং শত্রুর রাডার এড়িয়ে চালাকি করে আঘাত হানার জন্য থ্রাস্ট-ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ ও ফিন ব্যবস্থাও রয়েছে।
এই ক্রয় চুক্তির মাধ্যমে চীন আরও একবার প্রমাণ করল যে দক্ষিণ এশিয়ায় তার সামরিক প্রভাব এখন গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত।
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৭০ শতাংশ সামরিক সরঞ্জাম চীন থেকে আমদানি করা, যার মধ্যে রয়েছে ট্যাংক, যুদ্ধজাহাজ, রাডার, ও যুদ্ধবিমান।
এসওয়াই-৪০০ যুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশের সামরিক কাঠামো এখন আরও দৃঢ়ভাবে চীনা প্রযুক্তি ও লজিস্টিক ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে—যা একদিকে কৌশলগত সহযোগিতা বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে ঢাকার কূটনৈতিক ভারসাম্য নীতিকে আরও বাস্তব রূপ দিচ্ছে।
বিগত এক দশক ধরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বড় সীমাবদ্ধতা ছিল দূরপাল্লার আর্টিলারি ও ক্ষেপণাস্ত্রের অভাব।
২০২০ সালে মিয়ানমার যখন নিজেদের এসওয়াই-৪০০ ব্যাটারি স্থাপন করে, তখন থেকেই বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন—বিশেষত চট্টগ্রাম বা কক্সবাজারের মতো কৌশলগত স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে।
এখন বাংলাদেশও সেই সামরিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনল।
নতুন এই সিস্টেমের মাধ্যমে ঢাকার পাল্টা প্রতিরোধ ক্ষমতা এখন মিয়ানমারের রাখাইনভিত্তিক ঘাঁটি ও রাডার স্টেশনে পৌঁছে গেছে।
ভারতের ক্ষেত্রেও এর কৌশলগত তাৎপর্য স্পষ্ট।
যদিও ঢাকা ও নয়াদিল্লির সম্পর্ক সাধারণত বন্ধুত্বপূর্ণ, তবে সীমান্ত ও পানিবণ্টন ইস্যুতে মাঝে মাঝে উত্তেজনা তৈরি হয়।
এসওয়াই-৪০০-এর ২৮০ কিলোমিটার পাল্লা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু ঘাঁটিকেও তাত্ত্বিকভাবে আওতায় আনে—যা ঢাকাকে “ন্যূনতম বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরোধ” নীতির আওতায় এক কৌশলগত নিরাপত্তা বলয় প্রদান করছে।
এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হলে সেনাবাহিনীকে নতুন টার্গেটিং ডকট্রিন, ডিজিটাল কমান্ড ও কন্ট্রোল নেটওয়ার্ক, এবং ইন্টেলিজেন্স-সারভেইলেন্স সিস্টেমের সঙ্গে সমন্বয় ঘটাতে হবে।
চীন এই ধাপে প্রযুক্তিগত পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ সহায়তা দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ভবিষ্যতে বাংলাদেশ স্থানীয়ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও সমাবেশ সুবিধা গড়ে তুলতে পারে—যা কেবল আত্মনির্ভরতা বাড়াবে না, বরং দেশকে দক্ষিণ এশিয়ার চীনা ক্ষেপণাস্ত্র রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে তুলতে পারে।
চীনের এসওয়াই-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র যুক্ত হওয়া কেবল একটি নতুন অস্ত্র কেনা নয়—এটি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা কৌশলের মানচিত্র বদলে দেওয়া এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।
এর মাধ্যমে ঢাকার প্রতিরক্ষা এখন আরও আধুনিক, নির্ভুল এবং সময়োপযোগী হয়ে উঠেছে।
যেভাবে এই সিস্টেমটি “ফোর্সেস গোল ২০৩০”-এর সঙ্গে সংহত হবে, সেটিই নির্ধারণ করবে এটি কেবল প্রতীকী শক্তি না সত্যিকারের প্রতিরক্ষা গ্যারান্টর হয়ে উঠবে।
তবে একটি বিষয় নিশ্চিত—
বঙ্গোপসাগরের আকাশে এখন থেকে বাংলাদেশের কণ্ঠ আরও জোরালো, আরও দ্রুত, এবং আগের চেয়ে অনেক বেশি নির্ভুল।

