যে দেশটির নাম শুনলেই চোখে ভাসে তপ্ত বালুরাশি আর ধূ-ধূ মরুভূমির ছবি, সেই সৌদি আরবেই এবার দেখা মিলল একেবারেই ভিন্ন দৃশ্যের। উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় হঠাৎ নেমে আসা তীব্র শীতল আবহাওয়ার কারণে পাহাড়, উঁচু ভূমি আর খোলা প্রান্তর ঢেকে গেছে বরফের চাদরে। মরুর বুকে এমন তুষারপাত—এ যেন অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য এক অভিজ্ঞতা।
গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার সৌদি আরবের একাধিক অঞ্চলে একযোগে তুষারপাত ও ভারী বৃষ্টি হয়। এর ফলে চিরচেনা মরুভূমির রূপ বদলে গিয়ে তৈরি হয় এক শীতল, প্রায় রূপকথার মতো পরিবেশ। উত্তরের তাবুক প্রদেশে অবস্থিত জাবাল আল-লাওজ পাহাড়ের পর্যটন এলাকা ট্রোজেনা পুরোপুরি তুষারে ঢেকে যায়। প্রায় ২ হাজার ৬০০ মিটার উচ্চতার এই পাহাড়ি অঞ্চলে তুষারপাতের পাশাপাশি হালকা বৃষ্টিও হয়েছে।
তাবুকের পাশাপাশি হাইল প্রদেশের হাইল শহরের আশপাশের পাহাড়ি এলাকাতেও বুধবার সন্ধ্যায় তুষারপাত দেখা যায়। এসব এলাকার ভিডিও ও ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়। মরুর দেশে বরফে ঢাকা পাহাড়—এই দৃশ্য অনেক সৌদি নাগরিকই জীবনে প্রথমবার দেখছেন।
শুধু উত্তরাঞ্চল নয়, দেশের মধ্যাঞ্চলেও ছিল বৈরী আবহাওয়ার প্রভাব। রাজধানী রিয়াদে বৃহস্পতিবার ভোর থেকেই শুরু হয় মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত। সারাদিন আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা। আবহাওয়ার এমন পরিস্থিতিতে রিয়াদের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাময়িকভাবে অনলাইন ক্লাস চালুর সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। কাসিম অঞ্চলের বুরাইদাহ শহরসহ আশপাশের এলাকাগুলোতেও ভারী বৃষ্টির খবর পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া আল-উলা, শাকরা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল, বির বিন হারমাস, আল-আইনাহ ও আম্মার এলাকায় হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সৌদির জাতীয় আবহাওয়া কেন্দ্র জানিয়েছে, রিয়াদের উত্তরের আল-মাজমা’আ ও আল-ঘাত গভর্নরেটেও বৃহস্পতিবার সকালে তুষারপাত হয় এবং উঁচু ও খোলা এলাকায় বরফ জমে থাকতে দেখা গেছে।
জাতীয় আবহাওয়া কেন্দ্রের মুখপাত্র হুসেইন আল-কাহতানি জানিয়েছেন, উত্তর দিক থেকে ধেয়ে আসা একটি শক্তিশালী শীতল বায়ুস্তরের সঙ্গে বৃষ্টিবাহী মেঘ যুক্ত হওয়াতেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর ফলে কিছু এলাকায় তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যায় এবং ভোরের দিকে তুষারপাতের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
তিনি আরও জানান, আগেই এ ধরনের আবহাওয়ার বিষয়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছিল এবং পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আগামী কয়েক ঘণ্টা তাপমাত্রা আরও কম থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের কিছু এলাকায় জমে থাকা তুষার বরফে পরিণত হতে পারে, তাই খোলা সড়কে চলাচলের সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানানো হয়েছে।
তবে বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও অনেক মানুষ এই বিরল দৃশ্য উপভোগ করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। আল-মাজমা’আ ও আল-ঘাত এলাকায় তুষারপাত দেখতে ভিড় করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। রিয়াদের বাসিন্দা থামর আল-ওতাইবি বলেন, “এটা আমাদের জন্য একেবারেই ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা। তাই বন্ধুবান্ধব নিয়ে এই শীতের বিস্ময় নিজ চোখে দেখতে এসেছি।” অন্যদিকে আবদুল হাম্মেদ নামের আরেক বাসিন্দা জানান, আবহাওয়ার কারণে পরিবারের নির্ধারিত আউটডোর আয়োজন বাতিল করে ঘরেই থাকার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী সময়ে পূর্বাঞ্চল, রিয়াদ ও কাসিমে দমকা হাওয়া, মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি এবং কোথাও কোথাও শিলাবৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। উত্তর সীমান্ত অঞ্চল, জৌফ, হাইল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলেও বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। কিছু এলাকায় কুয়াশা দেখা দিতে পারে এবং ধুলোময় ঝোড়ো হাওয়া বইতে পারে, বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে শীত আরও তীব্র হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে, সৌদির সিভিল ডিফেন্স বিভাগ পাহাড়ি উপত্যকা ও নিম্নাঞ্চলে অপ্রয়োজনে যাতায়াত এড়িয়ে চলার আহ্বান জানিয়েছে। আবহাওয়াবিদদের মতে, পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সক্রিয় গভীর নিম্নচাপের প্রভাবেই মরুপ্রধান সৌদি আরবে এমন বিরল তুষারপাত ও ভারী বৃষ্টির ঘটনা ঘটেছে—যা সাম্প্রতিক সময়ে অঞ্চলটির আবহাওয়াগত ইতিহাসে একেবারেই ব্যতিক্রমী।

