রাহুল গান্ধী ১৯ জুন ১৯৭০ সালে নয়া দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলো রাজীব গান্ধী । তিনি ছিলেন ভারতের ষষ্ঠ এবং কনিষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রী। ১৯৮৪ সালে ৩১ অক্টোবর মাত্র ৪০ বছর বয়সে মা ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করেছিলেন।
শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর জন্ম ১৯১৭ সালের ১৯ নভেম্বর । স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধী ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন। শৈশবে তিনি ‘বাল চড়কা সঙ্ঘ’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে, ১৯৩০ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় কংগ্রেসকে সাহায্য করার জন্য ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন ‘বানর সেনা’। তাকে কারাবন্দী করা হয় ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রাক্তন সভানেত্রী এবং ভারতের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী। ইন্দিরা গান্ধীই হলেন একমাত্র মহিলা যিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। পারিবারিক পরিচয়ে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর কন্যা ইন্দিরা ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭৭ সালের মার্চ এবং পুনরায় ১৯৮০ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৮৪ সালের অক্টোবরে নিহত হওয়ার দিন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন। তিনিই ভারতে দ্বিতীয় দীর্ঘতম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন কর্মজীবনে বহু কৃতিত্ব ও সাফল্যের নজির রেখে গেছেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৭২ সালে তাঁকে ভারতরত্ন ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধে তাঁর বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিতে তিনি লাভ করেন মেক্সিকান অ্যাকাডেমি পুরস্কার (১৯৭২)।
রাহুল গান্ধী একজন ভারতীয় রাজনীতিবিদ এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি রাজীব গান্ধীর পুত্র , ইন্দিরা গান্ধীর নাতি এবং জওহরলাল নেহরুর প্রপৌত্রে জন্মগ্রহণ করেছিলেন , যাঁরা সকলেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন । তার মা সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেস পার্টিতেও প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে , রায়বারেলি লোকসভা কেন্দ্রের বর্তমান সাংসদ ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পার্টির সভাপতি এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্সের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
রাহুল গান্ধী তার প্রথম জীবনের বেশিরভাগ সময় একটু কম পাবলিক প্রোফাইল রেখেছিলেন। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর তিনি হোমস্কুলে ছিলেন। তিনি দিল্লির সেন্ট স্টিফেন কলেজে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শুরু করেন এবং পরে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন, কিন্তু ১৯৯১ সালে তার পিতার হত্যার পর তিনি ফ্লোরিডার উইন্টার পার্কের রোলিন্স কলেজে স্থানান্তরিত হন । তিনি ১৯৯৪ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং এক বছর পরে তিনি কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন । তারপর ভারতে ফিরে এসে মুম্বাইতে একটি ফার্ম প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করার আগে তিনি যুক্তরাজ্যের একটি পরামর্শক সংস্থার সাথে কাজ করেছিলেন।
রাহুল গান্ধী ২০০৪ সালে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন যখন তিনি প্রথমবার লোকসভায় নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালের প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরে তিনি সেখানে তার আসনটি রেখেছিলেন। ২০১৩ সালে তাকে কংগ্রেস পার্টির সহ-সভাপতি মনোনীত করা হয়েছিল এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর জন্য তার কার্যত (যদিও কখনই আনুষ্ঠানিক নয়) প্রার্থী হয়েছিলেন। যদিও তিনি সেই নির্বাচনে তার লোকসভা আসনটি আবার ধরে রেখেছিলেন, তার দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) কাছে অপমানজনক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল যখন দুর্নীতির কেলেঙ্কারির কারণে কংগ্রেসের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছিল। নির্বাচনে কংগ্রেস পার্টির খারাপ পারফরম্যান্স সত্ত্বেও, গান্ধী এবং তার মা তাদের নেতৃত্বের অবস্থান ধরে রেখেছিলেন।
সোনিয়া গান্ধী নেতৃত্ব থেকে অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে ২০১৭ সালের শেষের দিকে তিনি কংগ্রেস পার্টির প্রধান হন। নেহরু-গান্ধী রাজবংশের চতুর্থ প্রজন্ম হিসেবে তিনি অভিজাত এবং অলস ছিলেন । হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রধান দেবতা শিবের প্রতি ভক্তির বাহ্যিক প্রদর্শনের জন্য বিজেপির সদস্যদের দ্বারা এবং তার নিজের দলের সদস্যদের দ্বারাও তিনি সমালোচিত হন , যাকে অনেকে রাজনৈতিক স্টান্ট বলে উড়িয়ে দিয়েছিল যার অর্থ হিন্দু জনতাবাদের প্রতি বিজেপির আবেদনে ট্যাপ করা। তবুও, কিছু পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করেছিলেন যে গান্ধীর হিন্দু ভক্তির প্রদর্শন এবং দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলিকে একত্রিত করার জন্য তার প্রচেষ্টা কংগ্রেসকে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং ছত্তিশগড়ের হিন্দু দুর্গে অনুষ্ঠিত ২০১৮ সালের রাজ্য নির্বাচনে বিজেপিকে ছাড়িয়ে যেতে সাহায্য করেছিল । কংগ্রেস ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সামান্যই ভালো পারফরম্যান্স করেছিল, তবে, তাকে দলের নেতৃত্ব থেকে সরে যেতে প্ররোচিত করেছিল । ২২ শে অক্টোবর যখন সোনিয়া গান্ধী পদত্যাগ করেন এবং প্রবীণ কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খারগে দলের সভাপতির দায়িত্ব নেন তখন উত্তরসূরি পাওয়া না যাওয়া পর্যন্ত সোনিয়া গান্ধীকে কংগ্রেস পার্টির নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে গান্ধীকে মানহানির জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল এবং তার মন্তব্যের জন্য দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল যেটি “মোদী” উপাধিধারী লোকদের চোর হিসাবে উল্লেখ করেছিল – ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মতো একই উপাধি । বাদী, পূর্ণেশ মোদি নামে একজন বিজেপি বিধায়ক, যুক্তি দিয়েছিলেন যে গান্ধী “মোদী” উপাধি দিয়ে লোকেদের মানহানি করেছিলেন। তার দোষী সাব্যস্ত হওয়ার একদিন পর , গান্ধী ভারতীয় পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে অযোগ্য ঘোষিত হন। ৪ আগস্ট, ২০২৩-এ, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট গান্ধীর দোষী সাব্যস্ততা স্থগিত করে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে সংসদ সদস্য হিসাবে পুনর্বহাল করা হয়।
রাহুল গান্ধী ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস পার্টির নেতৃত্ব দিয়েছেন, এবং সারা দেশে জনসাধারণের কাছে পৌঁছানোর জন্য দুটি ন্যায় যাত্রার (“ন্যায় সফর”) আয়োজন করেছেন । লোকসভা নির্বাচনের আগে এই ন্যায় যাত্রায় সামিলও হয়েছেন তিনি।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দেশের দক্ষিণতম প্রান্ত থেকে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করে কাশ্মীর পর্যন্ত একটানা পাঁচ মাস ধরে রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ দেশে রীতিমতো সাড়া ফেলেছিল পাশাপাশি রাহুল গান্ধী যে রাজনীতিবিদ হিসেবেও আন্তরিক ও সিরিয়াস, তার সেই নতুন পরিচিতিটাও ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছিল।
পরে দেশের পূর্বে মণিপুর থেকে পশ্চিমে মুম্বাই পর্যন্ত সেই পদযাত্রারই দ্বিতীয় পর্ব, ‘ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা’ও যথেষ্ঠ সফল ছিল।
রাহুল তখন প্রায়ই বলতেন, বিজেপির ঘৃণা ও বিদ্বেষের রাজনীতির বিরুদ্ধে তিনি ‘মহব্বত কা দুকান’ (ভালোবাসা বিলি করার দোকান) খুলতে চান, যে ভাবনাটাকে দেশের একটা বড় অংশের মানুষ সাদরে মর্যাদা দিয়েছিলেন।
তাৎক্ষণিকভাবে তখনই ভোটের বাক্সে হয়তো এর সুফল দেখা যায়নি, কিন্তু রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্য বাড়াতে এই যাত্রাগুলোর অবশ্যই খুব বড় ভূমিকা ছিল। লক্ষ্য করার বিষয় হল, রাহুলকে বিজেপির ‘পাপ্পু’ বলে আক্রমণ করাটাও ক্রমশ বন্ধ হয়ে এসেছিল।
এবারের লোকসভা নির্বাচনে এসে দেখা যাচ্ছে, সেই রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বেই কংগ্রেস কিন্তু প্রায় ‘সেঞ্চুরি’ করে ফেলেছে, তাদের নিজেদের আসন সংখ্যা গতবারের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ করতে পেরেছে। এমন কী, বিরোধী শিবির যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে কাউকে তাদের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তুলে ধরেনি দেশের মানুষের চোখে রাহুল গান্ধীই কিন্তু ছিলেন মোদীর অঘোষিত চ্যালেঞ্জার। ফলে নরেন্দ্র মোদির কোনও বিকল্প নেই, বিজেপি এই যে কথাটা এতদিন ধরে বলে এসেছে, সেই ‘টিনা’ ফ্যাক্টরও (‘দেয়ার ইজ নো অল্টারনেটিভ’) এবারের ভোটে সেভাবে কাজ করেনি। কারণ রাহুল গান্ধী ছিলেন, তার নেতৃত্বে কংগ্রেসও ছিল উজ্জীবিত ভূমিকায়।
উত্তরপ্রদেশে যেমন রাহুল গান্ধী ও সমাজবাদী পার্টির তরুণ নেতা অখিলেশ যাদবের ‘জুটি’ রাজ্যে দারুণ হিট তাদের দুই দলের জোট সেখানে ৪৩টি আসন পেয়ে বিজেপিকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে। কংগ্রেস যেখানে একটা সময় ওই রাজ্যে অস্তিত্ত্ব বাঁচানোর জন্য লড়ছিল, সেখান থেকেই তারা এবার পাঠাচ্ছে ছ’জন এমপিকে।
সামগ্রিকভাবে কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিরোধীদের ‘ইন্ডিয়া’ জোটও যেভাবে শেষ পর্যন্ত ২৩২ টি আসন পেয়েছে, সেটাও অনেকেই ভাবতে পারেননি। এই জোটের বৃহত্তম দল হওয়া সত্ত্বেও কংগ্রেস যেভাবে অন্য শরিকদের মান-অভিমান ও ‘ইগো’কে মর্যাদা দিয়ে শেষ পর্যন্ত জোটটাকে মোটামুটি ঐক্যবদ্ধ রাখতে পেরেছে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সে জন্য রাহুল গান্ধীর কুশলী নেতৃত্বর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছেন।
কংগ্রেসসহ বিরোধীদের এই ‘পুনরুত্থান’ যে তৃতীয় দফায় নরেন্দ্র মোদির অগ্রযাত্রা অনেকটা প্রতিহত হওয়ার একটা বড় কারণ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
এ যাবত রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনকেও বিশ্লেষকরা মোটামুটি দুভাগে ভাগ করেন। প্রথম পর্বের ছেলেমানুষি, খামখেয়ালিপনা, সিরিয়াসনেসের অভাব এগুলোকে কাটিয়ে উঠে গত তিন-চার বছরে তিনি যেন অনেক পরিণত, বিচক্ষণ হয়েছেন এবং অনেক বেশি মাটির কাছাকাছি আসতে পেরেছেন এটা তার সমালোচকরাও আজকাল স্বীকার করেন।