ঐতিহ্য, সংগ্রহ, এবং সাংস্কৃতিক সম্প্রীতির এক অনন্য নিদর্শন হ্যালিফ্যাক্স সেন্ট্রাল লাইব্রেরি।
কানাডার আটলান্টিক প্রদেশ নোভাস্কোশিয়ার রাজধানী হ্যালিফ্যাক্স, দেশটির অন্যতম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এখানে শীতের ঠান্ডা ছাপিয়ে মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য আর স্থাপত্যশৈলী ভাস্বর। কানাডার বিস্তৃত ভূখণ্ডের এক ছোট্ট অংশ হলেও, হ্যালিফ্যাক্স তার ইতিহাস ও সংস্কৃতির দিক থেকে গভীর ও সমৃদ্ধশালী। শহরটিতে থাকা লাইব্রেরিগুলোর মধ্যে হ্যালিফ্যাক্স সেন্ট্রাল লাইব্রেরি শুধু একটি পাঠাগার নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক মিলনস্থল। পাঁচতলা এই লাইব্রেরি দেখতে এক ভিন্নধর্মী স্থাপত্যকর্ম, যা দূর থেকে দেখলে মনে হয় সাজানো বইয়ের তাক। কাঁচনির্মিত এই ভবন তার স্বচ্ছতা, উন্মুক্ত পরিবেশ এবং আধুনিক সুবিধার জন্য ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক স্থাপত্যের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
হ্যালিফ্যাক্স পাবলিক লাইব্রেরির ইতিহাসের পেছনে রয়েছে ১৮৬৪ সালের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা। নোভাস্কোশিয়ার খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ স্যার উইলিয়াম ইয়ং ঋণগ্রস্ত লাইব্রেরিটি ক্রয় করে তা নগরবাসীর জন্য উন্মুক্ত করেন। সেই থেকে হ্যালিফ্যাক্সের লাইব্রেরি সংস্কৃতির শুরু। ব্রিটিশ ম্যাকানিকস ইনস্টিটিউটস-এর আদলে তৈরি এই লাইব্রেরি তখনকার সমাজে সাধারণ মানুষকে জ্ঞানার্জনের সুযোগ করে দেয়। ধীরে ধীরে এটি একটি বড় পাবলিক লাইব্রেরিতে পরিণত হয়। স্যার ইয়ং এর নেতৃত্বে লাইব্রেরির ধারাবাহিক অগ্রযাত্রা আজকের আধুনিক হ্যালিফ্যাক্স সেন্ট্রাল লাইব্রেরি পর্যন্ত পৌঁছেছে।
১৯৯৫ সালে হ্যালিফ্যাক্স পাবলিক লাইব্রেরি সিস্টেম প্রতিষ্ঠিত হয়, যার অধীনে পুরো শহরের লাইব্রেরিগুলোকে সংযুক্ত করা হয়। ২০১৪ সালে বর্তমান সেন্ট্রাল লাইব্রেরি উদ্বোধন করা হয়, যা এখন শহরের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। এখানে পাঠকরা এক লাইব্রেরির কার্ড দিয়ে পুরো সিস্টেমের মধ্যে অবাধে বই ধার করতে এবং ফেরত দিতে পারেন।
২০১০ সালে এক আন্তর্জাতিক নকশা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এই ভবনের নকশা তৈরি করা হয়। ল্যান্ডমার্ক হিসেবে গড়ে ওঠা এই ভবনটি পাঁচ তলা বিশিষ্ট। এর প্রতিটি তলায় রয়েছে ভিন্ন ধরনের সুবিধা, যা শুধুমাত্র বই পড়ার জন্য নয়, বরং সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্যও ব্যবহৃত হয়। ভবনের পঞ্চম তলায় একটি আকর্ষণীয় ক্যাফে রয়েছে যা আপনাকে হ্যালিফ্যাক্সের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করতে সাহায্য করবে।
অভ্যন্তরীণ অংশে প্রতিটি ফ্লোরের মধ্যে সোপানগুলো এমনভাবে সাজানো যে, নিচ থেকে উপরের দিকে তাকালে এটি সত্যিকার অর্থে একটি বইয়ের ভেতরে প্রবেশের অনুভূতি দেয়। এই ভবনটি পরিবেশগতভাবে টেকসই। বৃষ্টির পানি পুনঃব্যবহার করে ভবনের বিভিন্ন কাজ পরিচালনা করা হয়। ২০১৪ সালে এই ভবনটি লেফটেন্যান্ট গভর্নর পুরস্কার এবং ২০১৬ সালে গভর্নর জেনারেল মেডেলে ভূষিত হয়।
প্রথম তলায় রয়েছে সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন এবং জনপ্রিয় বইয়ের সংগ্রহশালা। এছাড়াও, এখানে ৩০০ আসনের মিলনায়তন এবং একটি ক্যাফে রয়েছে। দ্বিতীয় তলায় শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য বইয়ের বিশাল সংগ্রহ, কম্পিউটার ও খেলাধুলার জায়গা, তৃতীয় তলায় রয়েছে বাংলা সহ বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য সংগ্রহ এবং আদিবাসী সংস্কৃতি বিষয়ক বই। চতুর্থ তলায় নোভাস্কোশিয়ার স্থানীয় ইতিহাস সংক্রান্ত বই এবং গবেষণাধর্মী সাহিত্য মজুদ রয়েছে। পঞ্চম তলায় রয়েছে ছাদের ওপরে ক্যাফে, যেখানে বসে পাঠকেরা উপন্যাস ও গল্পের বই নিয়ে সময় কাটাতে পারেন।
হ্যালিফ্যাক্সের লাইব্রেরি সিস্টেমটি বই ধার এবং ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক সুবিধা প্রদান করে। লাইব্রেরির নিজস্ব ওয়েবসাইট থেকে যে কেউ তাদের প্রয়োজনীয় বই অনলাইনে অর্ডার করতে পারেন এবং পাঠকের জন্য উপলব্ধ হলে নোটিফিকেশন পাবেন। বইয়ের ধারকৃত সময় তিন সপ্তাহের জন্য, তবে অন্য পাঠক একই বই ধার করতে না চাইলে তিনবার পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করা সম্ভব।
বই ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া এখানকার অন্যতম আকর্ষণ। লাইব্রেরিতে একটি স্বয়ংক্রিয় বই ফেরত দেওয়ার প্রবেশপথ রয়েছে। বইটি প্রবেশপথের কাছে আনলেই দরজা স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যাবে এবং নির্দেশনা অনুসারে বইটি সেখানে জমা দেওয়া যাবে। প্রতিবার একেকটি বই জমা দিতে হবে এবং স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র তা গ্রহণ করে নিবে।
হ্যালিফ্যাক্স সেন্ট্রাল লাইব্রেরির তৃতীয় তলায় রয়েছে বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য বিভাগের একটি বিশেষ স্থান, যেখানে রয়েছে বাংলা সাহিত্যের একটি সংগ্রহ। এই লাইব্রেরিতে মোট ৫৭টি বাংলা বই সংরক্ষিত আছে, যা স্থানীয় বাঙালি পাঠকদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এটি কানাডার অন্যান্য শহরের লাইব্রেরিগুলোর তুলনায় উল্লেখযোগ্য, যেখানে বাংলা সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিক সংগ্রহের অভাব রয়েছে। সিডনি এবং কেপ ব্রেটন শহরে বাংলা সাহিত্য সংগ্রহের অভাব অনুভব করার পর এই লাইব্রেরিতে বাংলা বইয়ের উপস্থিতি নিঃসন্দেহে এক স্বস্তির নিঃশ্বাস।
বাংলা সাহিত্যের এই সংগ্রহ কেবলমাত্র স্থানীয় বাঙালি সম্প্রদায়ের জন্য নয়, বরং কানাডায় বসবাসরত সকল পাঠকের জন্য একটি শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক সম্প্রীতির সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে সক্ষম। এখানে রয়েছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস এবং অন্যান্য সাহিত্যের শাখা, যা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
হ্যালিফ্যাক্সে অবস্থানরত বাঙালি সম্প্রদায় তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির রক্ষার জন্য এই লাইব্রেরিকে কেন্দ্র করে নানাবিধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। এখানকার পাঠকরা শুধু বই পড়া নয়, বরং নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সাহিত্য আলোচনা, বই প্রকাশনা এবং বাঙালি উৎসবগুলো উদযাপন করে। লাইব্রেরিতে বাংলা বইয়ের সংগ্রহ থাকায় নতুন প্রজন্মের জন্য তাদের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি ধরে রাখা এবং তাদের পরিচিতি গড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
এছাড়া, সেন্ট্রাল লাইব্রেরির বিশাল সুযোগ-সুবিধার মধ্যে বাংলা সাহিত্য নিয়ে বিভিন্ন কর্মশালা, লেখালেখি ও সাহিত্যচর্চার সভা অনুষ্ঠিত হয়, যা নতুন লেখক এবং পাঠকদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। স্থানীয় বাঙালি লেখকরা এখানে এসে তাদের সৃষ্টি উপস্থাপন করতে পারেন, যা সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
হ্যালিফ্যাক্স সেন্ট্রাল লাইব্রেরি কেবল একটি বই পড়ার জায়গা নয়, এটি একটি জীবনধারার অংশ, যেখানে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক সাহিত্য, সংস্কৃতি, এবং জ্ঞানের বাণিজ্য ঘটে। এখানে যে কোনো বয়সের পাঠক নিজেদের আগ্রহের বই খুঁজে পাবেন, এবং নানান কার্যক্রমের মাধ্যমে একত্রিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে থাকেন। লাইব্রেরির অবকাঠামো এবং সুবিধাগুলো শুধু পাঠকদের জন্যই নয়, বরং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের জন্য শিক্ষা ও উন্নয়নের পথ খুলে দিয়েছে।
সার্বিকভাবে, হ্যালিফ্যাক্স সেন্ট্রাল লাইব্রেরি কানাডার এক নান্দনিক ও প্রগতিশীল পাঠাগার হিসেবে পরিচিত। এটি বইপ্রেমীদের জন্য কেবল একটি পাঠাগার নয়, বরং এটি একটি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মিলনস্থল। পাঠকরা এখানে এসে বই পড়ার পাশাপাশি নতুন বন্ধু তৈরি করতে পারেন, বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে পারেন, এবং নিজেদের জ্ঞানকে আরো সমৃদ্ধ করতে পারেন।
এইভাবে, হ্যালিফ্যাক্স সেন্ট্রাল লাইব্রেরি কানাডায় একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, যেখানে বাংলা সাহিত্যও স্থান করে নিয়েছে। এটি স্থানীয় বাঙালি জনগণের জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে এবং শহরের বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক পরিবেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগের ভূমিকা পালন করছে।
হ্যালিফ্যাক্স সেন্ট্রাল লাইব্রেরির এই বৈচিত্র্যময় পরিবেশ এবং সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির জন্য এটি স্থানীয় জনগণের হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা, জ্ঞান অর্জনের তাগিদ, এবং সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির স্পৃহা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে এ লাইব্রেরি অব্যাহতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এখানকার পাঠকরা আজকের যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে সক্ষম হচ্ছে, যা সমগ্র সমাজের জন্যই কল্যাণকর।
এভাবেই হ্যালিফ্যাক্স সেন্ট্রাল লাইব্রেরি একটি প্রজ্ঞার বাতিঘর হিসেবে কাজ করে চলেছে, যা সত্যিকার অর্থে একটি উন্নত, শিক্ষিত এবং সংস্কৃতিসমৃদ্ধ সমাজ গড়ার লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছে।