মানুষের প্রকৃত চরিত্র তার ঘরের চার দেয়ালের ভেতর সবচেয়ে স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। বাইরে ব্যস্ততার সময় মানুষ নানা রূপ ধারণ করতে পারে, কিন্তু ঘরে এসে তার প্রকৃত স্বভাব ফুটে ওঠে। নবীজি মুহাম্মদ (সা.) এর জীবন এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে। বাইরের কাজের শেষে ঘরে ফিরে তিনি কোনো প্রকার ভণিতা বা ভন্ডামি ছাড়াই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বসতেন, ঘরোয়া কাজে অংশ নিতেন এবং নিজের কাজ নিজেই করতেন।
নবীজি (সা.) ঘরে ফিরে তার প্রকৃত চরিত্র প্রদর্শন করতেন। তিনি পারিবারিক কাজে সহযোগিতা করতেন এবং কখনো নিজের কাজ অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতেন না। ঘরের ছোটখাটো কাজও নিজ হাতে সম্পন্ন করতেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি ছাগ দোহন করতেন, নিজের পোশাকের উকুন পরীক্ষা করতেন এবং দৈনন্দিন অন্যান্য কাজ নিজেই করতেন। হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, নবীজি (সা.) ছিলেন মানুষের মধ্যে একজন মানুষ। পোশাকের মধ্যে তিনি উকুন খুঁজতেন, ছাগ দোহন করতেন এবং নিজের কাজ নিজেই করতেন। এই হাদিসটি শামায়েলে তিরমিজি, হাদিস: ৩৪২ এ উল্লেখ রয়েছে।
নবীজির ঘর ছিল সবচেয়ে বরকতময়। এই ঘর থেকেই ইসলামের আলোকবর্তিকা ছড়িয়েছিল। তবুও তিনি প্রায়শই অনাহারে থাকতেন। তার পরিবারের সদস্যদের জন্যও প্রায়ই খেজুরের মতো সহজ খাদ্য থাকত। নুমান ইবন বাশির (রা.) বর্ণনা করেছেন, “আমি নবীজিকে দেখেছি, পেট ভরে খাওয়ার মতো খারাপ খেজুরও তাঁর ঘরে থাকত না।” (শামায়েলে তিরমিজি, হাদিস: ৩৬৯)
কখনো তাঁর ঘরের চুলায় পুরো মাস আগুন জ্বলত না। এই সময়ে তাদের দিন কাটত শুধু পানি ও খেজুর খেয়ে। আয়েশা (রা.) বলেন, “আমরা মুহাম্মদ (সা.)-এর পরিবার সারাটা মাস এমন কাটাতাম যে আমরা আগুনও জ্বালাতাম না। শুধু খুরমা ও পানি খেয়ে দিন যাপন করতাম।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৭,১৮০)
নবীজি (সা.) ঘরে বিভিন্ন ঘরোয়া কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকলেও- আজান শুনলেই তিনি মসজিদের উদ্দেশে রওনা হতেন। আসওয়াদ ইবনে ইয়াজিদ (রহ.) বর্ণনা করেছেন, আয়েশাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, নবীজি (সা.) ঘরোয়া কাজে ব্যস্ত থাকতেন, আর আজান শুনলে মসজিদের উদ্দেশে বেরিয়ে যেতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪,৯৭২)
নবীজি (সা.) মসজিদে ফরজ নামাজ আদায় করতেন এবং অন্যদেরও মসজিদে ফরজ নামাজ আদায়ের গুরুত্ব বুঝাতেন। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত একটি হাদিসে বলা হয়েছে, “নামাজ দাঁড়িয়ে গেলে যে সম্প্রদায় নামাজে উপস্থিত হয় না, আমার ইচ্ছা হয় তাদের বাড়ি গিয়ে তা জ্বালিয়ে দিই।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২২৫৯)
তবে নবীজি (সা.) ঘরে নফল নামাজও আদায় করতেন এবং ঘরে নফল নামাজ পড়ার জন্য নির্দেশও দিতেন। তাহাজ্জুদের দীর্ঘ নামাজের অভ্যাসও ঘরে সম্পন্ন হতো। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, নবীজি ঘরে ঘরের কাজের পরে নফল নামাজ আদায় করতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪,৯৭২)
আব্দুল্লাহ ইবন সাদ (রা.) বলেন, “আমি নবীজিকে জিজ্ঞেস করলাম, নফল নামাজ আমার ঘরে পড়া উত্তম নাকি মসজিদে পড়া উত্তম? তিনি বললেন, তুমি দেখছ না আমার ঘর মসজিদের কত কাছে, তারপরও ফরজ নামাজ মসজিদে পড়ি, অন্য নামাজ ঘরে পড়া উত্তম।” (শামায়েলে তিরমিজি, হাদিস: ২৯৭)
নবীজি (সা.) ঘরকে সম্পূর্ণভাবে নামাজশূন্য রাখতে নিষেধ করতেন। যেই ঘরে নামাজ পড়া হতো, সেই ঘরকে কবরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, “তোমরা কিছু নামাজ ঘরে আদায় করবে, তবে তোমাদের ঘরকে কবরের সঙ্গে তুলনা করবে না।” (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ৯৩৮)
নবীজির প্রতিদিন ছিল কর্মমুখর। তাঁর কর্ম শুধু বাইরে সীমাবদ্ধ ছিল না; ঘরের ভেতরও তিনি সর্বদা ব্যস্ত থাকতেন। তিনি ঘরে ফিরে নিজের কাজ নিজ হাতে সম্পন্ন করতেন, এতে কোন দ্বিধাবোধ থাকত না। ঘরে তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আচরণে নম্র, সহযোগী এবং মানবিক থাকতেন। তাঁর আচরণ এবং জীবনযাপন আমাদের শেখায়, প্রকৃত মানবিক চরিত্র কেবল বাহ্যিক কৃতিত্বে নয়, বরং ঘরের ছোট ছোট কাজ এবং পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে ফুটে ওঠে।
নবীজি (সা.) এর ঘরের জীবন আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। তিনি তার পরিবার ও ঘরের কাজের প্রতি যত্নশীল ছিলেন, নিজের দায়িত্ব অন্যের ওপর চাপাতেন না। ছোটখাটো কাজও নিজের হাতে করতেন। ঘরে তিনি সহজ জীবনযাপন করতেন, প্রায়শই পানি ও খেজুরে দিন কাটাতেন এবং নামাজের জন্য ঘরকে সতর্কভাবে ব্যবহৃত করতেন।
এই ধরনের জীবনযাপন শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, মানবিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও শিক্ষণীয়। নবীজি (সা.) এর জীবন আমাদের শেখায় যে, ঘরে ও পরিবারের মধ্যে নম্রতা, সহযোগিতা, দায়িত্বশীলতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণই প্রকৃত মানবিক চরিত্রের পরিচয়।