রাজধানীর বাদ্যযন্ত্রের দোকানগুলোতে এখন নীরবতা। গিটার, কি-বোর্ড, তবলা, হারমোনিয়াম—সব সাজানো, কিন্তু ক্রেতার দেখা নেই। আগে যেখানে ক্রেতার ভিড় সামলাতে ব্যস্ত থাকতেন বিক্রেতারা, সেখানে এখন দিনের পর দিন বিক্রি ছাড়া সময় কাটছে।
দেশের বড় বাদ্যযন্ত্রের বাজার এলিফ্যান্ট রোড, সায়েন্স ল্যাব, বসুন্ধরা সিটি, শাঁখারীবাজার—সব জায়গাতেই একই অবস্থা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক বছরে বাজারে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে। নিয়মিত বাদ্যযন্ত্র ক্রেতারা আর দোকানে আসছেন না।
বাজার বিশেষ করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কনসার্ট ও স্টেজ শো-এর ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু গত এক বছরে এসব অনুষ্ঠান কমে গেছে। বড় কনসার্ট বন্ধ থাকায় সাউন্ড সিস্টেম, গিটার, ড্রামসেট, কি-বোর্ডের চাহিদা কমেছে। ছোট আকারের সাংস্কৃতিক আসরও কম হওয়ায় হারমোনিয়াম, তবলা, বাঁশি, একতারার মতো ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রের বিক্রি নেই বললেই চলে।
বাংলাদেশে বাদ্যযন্ত্র বাজারের আনুষ্ঠানিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে সংশ্লিষ্টদের ধারণা, স্থানীয় উৎপাদন ও আমদানি মিলিয়ে বাজারের আকার প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা। গিটার, পিয়ানো, হারমোনিয়াম, ড্রাম সেটসহ অন্তত ১২ ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাংলাদেশে আমদানি হয়। এছাড়া ভারত থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে তবলা ও ঢোলসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র আসে।
জার্মানভিত্তিক স্ট্যাটিস্টার অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের বাদ্যযন্ত্র বাজারের আকার ৬৩৫ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৭,৮১১ কোটি টাকা। তবে অনেকে মনে করেন, এ সংখ্যা প্রকৃত বাজারের তুলনায় অনেক বেশি।
সায়েন্স ল্যাবের বড় বাদ্যযন্ত্র প্রতিষ্ঠান অ্যাকোস্টিকার স্বত্বাধিকারী সৈকত বিশ্বাস টুটুল বলেন, ‘বাজারের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। কনসার্ট ও সংগীতাঙ্গন প্রায় স্থবির। বিক্রি ৫০ শতাংশের বেশি কমে গেছে। আগে দিনে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা বিক্রি হতো, এখন ৩০ হাজার টাকাও কষ্টে। ছোট-বড় সব ধরনের শো বন্ধ থাকায় পরিস্থিতি খারাপ।’
নিউ সংগীতার স্বত্বাধিকারী শংকর পৈত বলেন, ‘বিক্রি এখন নেই বললেই চলে। করোনার সময় থেকেই ব্যবসা খারাপের দিকে যাচ্ছিল। এখন পরিস্থিতি আরো কঠিন। বিক্রি আগের তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ কমে গেছে।’
বসুন্ধরা সিটির ‘গিটার সেন্টার’-এর এক কর্মচারী বলেন, ‘আজ সারা দিন কোনো বিক্রি হয়নি। আগে প্রতিদিন কয়েকটি গিটার, কি-বোর্ড, অ্যামপ্লিফায়ার বা সাউন্ড সিস্টেম বিক্রি হতো। এখন সেই ক্রেতারা নেই। নাশিদ বা গজলের সঙ্গে সম্পর্কিত যন্ত্র কিছুটা বিক্রি হলেও আয় কম।’
কয়েকটি দোকানের ম্যানেজার বলেন, কনসার্ট, স্টেজ শো ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ বা কমে যাওয়াই বাজারের স্থবিরতার প্রধান কারণ। অনুষ্ঠান না থাকায় শুধু বিক্রি নয়, পুরো ব্যবসায়িক চক্রই ক্ষতিগ্রস্ত। পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে দোকান মালিকদের টিকে থাকা কঠিন।
রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডেও তেমন ক্রেতা নেই। আগে ক্রেতারা গিটার বা হারমোনিয়াম বাজিয়ে দেখতেন, মডেলের তুলনা করতেন। মাঝেমধ্যে কেউ শখে ছোট যন্ত্র কিনলেও আয়ের ধারায় কোনো উল্লেখযোগ্য প্রভাব নেই।
হার্ড রক ও মেটাল ব্যান্ড ওয়ারফেজের দলনেতা শেখ মনিরুল আলম টিপু বলেন, ‘কনসার্ট বা স্টেজ শো নেই বললেই চলে। প্রভাব পড়ছে শিল্পী, বিক্রেতা, সাউন্ড সিস্টেম, লাইটিং—পুরো ইন্ডাস্ট্রিতে। কোনো অনুষ্ঠান না থাকলে আয় বন্ধ।’
যেসব দোকান ইভেন্ট বা ব্যান্ডের জন্য সরঞ্জাম ভাড়া দিত, তাদের আয়ও বন্ধ হওয়ার উপক্রম। প্রযুক্তিনির্ভর যন্ত্র স্থান দখল করলেও, কারিগররা বিকল্প পেশায় যাচ্ছেন। মেলোডি অ্যান্ড কোং, যতীন অ্যান্ড কোংসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান একই পরিস্থিতির মুখোমুখি। এক বছর ধরে ‘অভূতপূর্ব মন্দা’ চলছে।
এক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বত্বাধিকারী বলেন, ‘যারা নিয়মিত বাদ্যযন্ত্র কিনতেন, তারা এখন আসছেন না। টুকটাক বিক্রি শখের জন্য হচ্ছে। তবলা, পিয়ানো, হারমোনিয়ামের ব্যবসা একেবারেই বন্ধ।’
কর্মীদের ওপর প্রভাব পড়েছে। আয় কমে নিয়মিত বেতন দেয়া যাচ্ছে না, অনেককে ছাঁটাই করতে হয়েছে। শিল্পীরা নতুন বাদ্যযন্ত্র কিনছেন না। দোকানগুলোও সংকটে। পুরো এলাকায় নীরবতা, যন্ত্র বিক্রির দোকান খোলা থাকলেও ক্রেতা নেই।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজার স্বাভাবিক করতে কনসার্ট, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সামাজিক আয়োজন ফিরিয়ে আনা জরুরি। নইলে বাদ্যযন্ত্রের বাজার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়বে। অনেক দোকান আকার ছোট করেছে বা অংশীদারিত্বে পরিচালিত হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সংগীতশিল্পী বলেন, ‘অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর কাজ নেই বললেই চলে। আউটডোর শো বন্ধ, অনুমতিও মিলছে না। ইনডোর শোও জীবিকা নির্বাহ সম্ভব নয়। পুরো ইকোসিস্টেম প্রভাবিত হয়েছে। কমপক্ষে পাঁচ লাখ মানুষ এ খাতে বেকার।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের চেয়ারম্যান প্রিয়াংকা গোপ বলেন, ‘নতুন কাজের সুযোগ কমে গেছে। বড় আকারের শো নেই বললেই চলে। বাদ্যযন্ত্রে আগ্রহও কমেছে। কারাওকের সহজলভ্যতার কারণে মানুষ সরাসরি বাদ্যযন্ত্র বাজানোর চেয়ে মিউজিক চালিয়ে গান গাইতে বেশি মন দিচ্ছে। শখে গিটার কিনার সংখ্যাও কমে গেছে। দাম বৃদ্ধিও প্রভাব ফেলেছে।’