ঢাকার নবাবি রত্নভান্ডারের অন্যতম অমূল্য হীরা দরিয়া-ই-নূর, যা ‘কোহিনূরের সহোদর’ নামে পরিচিত, ১১৭ বছর ধরে সোনালী ব্যাংকের ভল্টে বন্দি ছিল। হীরাটির উত্স কোহিনূরের মতোই দক্ষিণ ভারতের গোলকুন্ডা অঞ্চলের খনিজ শাসকদের কাছে।
১৯০৮ সালে ব্যাংকের ভল্টে রাখা এই রত্ন ১৯৪৭ সালের দেশভাগ বা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর অক্ষত আছে কি না তা নিয়ে দীর্ঘদিন জল্পনা চলে এসেছে। অনেকের ধারণা, এটি হয়তো হারিয়ে গেছে। অবশেষে সরকার ভল্ট খোলার জন্য একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শওকত আলী খান জানান, ভল্টটি এখনও সিলগালা অবস্থায় রয়েছে। বহু বছর আগে একটি পরিদর্শক দল ভল্টের কক্ষের দরজা খোললেও ভল্ট সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয়নি। ভল্ট খোলার নির্দিষ্ট কোনো তারিখ এখনও নির্ধারিত হয়নি।
দরিয়া-ই-নূরের ইতিহাস সমৃদ্ধ। লাহোরের রাজন্যবর্গের কাছে উত্তোলিত এই হীরা পরে ব্রিটিশ রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে পাঠানো হয়েছিল। তবে বড় হীরেটি রানির কাছে বেশি আকর্ষণ সৃষ্টির কারণে কোহিনূর লন্ডনে থেকে গেলেও দরিয়া-ই-নূর ভারতে ফেরত আসে। ১৮৫২ সালে নিলামে ৭৫ হাজার টাকায় নবাব আলিমুল্লাহ হীরাটি কিনে নেন। এরপর থেকে এটি নবাব পরিবারের কাছে থাকতো। ১৯০৮ সালে ঋণগ্রস্ত নবাব সলিমুল্লাহ হীরাটিকে বন্ধক রেখে অন্যান্য স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তিসহ সোনালী ব্যাংকে জমা দেন।
হীরাটি কখনো বাজুবন্ধে, কখনো পাগড়ির সঙ্গে পরা হতো। এর সঙ্গে আরও কয়েকশ রত্নালঙ্কারও ব্যাংকের ভল্টে রাখা ছিল। সেনাশাসনের পরও তিন দশক ধরে ভল্ট খোলা হয়নি। এর ফলে হীরার অবস্থান ও নিরাপত্তা নিয়ে দীর্ঘদিন রহস্য সৃষ্টি হয়।
দরিয়া-ই-নূর ২৬ ক্যারেটের হীরার মধ্যে অন্যতম, যার ঐতিহাসিক মূল্যও সমান গুরুত্ব বহন করে। এটি কোহিনূরের নিকট-আত্মীয় হিসেবে পরিচিত। ভারতে ফেরার পর এটি নবাব পরিবারের কাছে আসে এবং পরবর্তী সময়ে সোনালী ব্যাংকের ভল্টে স্থায়ী হয়।
ভল্টে থাকা কারণে দরিয়ার কোনো চিত্র বা প্রকাশনা সীমিত। সর্বশেষ ১৯৮৫ সালে ভল্ট খোলা হয়েছিল, কিন্তু ছবি তোলার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ইতিহাসবিদ ও রত্নবিশেষজ্ঞদের মতে, হীরার পুরোনো ছবি আহসান মঞ্জিল ও বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে পাওয়া যায়। ১৮৪১ সালে হাঙ্গেরিয়ান পেইন্টার আগস্ট শেফটের আঁকা একটি ছবিতে রাজার হাতে দরিয়া-ই-নূরের বাজুবন্ধ স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
ব্রিটিশ আমলে হীরার আরও দুটি দুর্লভ ছবি পাওয়া যায়। ১৮২ ক্যারেটের গোলাপী হীরা, নাদির শাহের সংগ্রহ থেকে পারস্যে যায়। পরবর্তীকালে কোহিনূর ও দরিয়া-ই-নূর পাঞ্জাবের মহারাজা রণজিৎ সিংয়ের কাছে পৌঁছে। ১৮৫১ সালের গ্রেট এক্সিবিশনে ব্রিটেনে প্রদর্শিত হলেও হীরাটি পরে ভারতে ফেরত পাঠানো হয়।
দরিয়া-ই-নূরের সম্পূর্ণ তথ্যসংগ্রহ হ্যামিল্টন অ্যান্ড কোম্পানি ও বিভিন্ন জাদুঘরের নথি থেকে পাওয়া যায়। ২৬ ক্যারেটের হীরাটির সঙ্গে অতিরিক্ত ১১টি মুক্তা ও হীরা যুক্ত ছিল। লাহোর দরবারের তালিকায় এর মূল্য ৬৩ হাজার রুপি বা ছয় হাজার পাউন্ড লেখা ছিল।
বর্তমানে হীরা সোনালী ব্যাংকের ভল্টে সুরক্ষিত। জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী জানিয়েছেন, হীরাটি প্রদর্শনের জন্য জাদুঘরে আনা সম্ভব হয়নি। অন্যান্য রত্নালঙ্কারের সঙ্গে নিরাপত্তার কারণে সরকারের অনুমতি মেলেনি।
প্রতিটি প্রমাণ ও নথি অনুযায়ী, দরিয়া-ই-নূর এখনও সোনালী ব্যাংকের ভল্টে অক্ষত রয়েছে।
সূত্র: The illustrated London news. v.18 1851 Jan-Jun, The Crystal Palace, and its contents (1851), Baggage & Belonging Catalogue 2020, National Museums Scotland, The Koh-i-nûr armlet c. 1830, Royal Collection Trust, Daryā-ye Nur: History and Myth of a Crown Jewel of Iran, Anna Malecka, History of Kohinoor, Darya-i-Noor and Taimur’s Rub, 1985, De Maandelykse Nederlandische Mercurius, Volumes 16-19, ‘Casualty of War: A Portrait of Maharaja Duleep Singh’ – A Summary, 2013, Meet Daria-i-Noor, Shyam Bhatia, Maharaja Sher Singh Wearing the Koh-I-Noor Diamond c1841-42, UK Punjab Heritage Association, The Jewellery Of The Last Sikh Emperor: Maharaja Duleep Singh, Our Viceregal Life in India: Selections from My Journal, 1884-1888, Jewellery collection of Dhaka Nawab Family, Bangladesh on Record, ঢাকা নবাব এস্টেট কোর্ট অব ওয়ার্ডসের ইনডেনচারের বিবরণ, ভূমি সংস্কার বোর্ড।