শিশুকে আলাদা ঘরে শোয়ানো শৈশবের একটি প্রাকৃতিক নিয়ম, যা তাদের স্বাধীনতা, আত্মনির্ভরতা ও নিজস্বতা গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিশু যত আগে ধীরে ধীরে এই অভ্যাসের সঙ্গে মানিয়ে নেয়, তত সহজে তারা একা ঘুমে অভ্যস্ত হয় এবং পরবর্তীতে মানসিক ও সামাজিক দিক থেকেও উপকৃত হয়। নিচে পাঁচটি প্রধান পরামর্শ বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো।
১. কখন থেকে শুরু করবেন: শিশু সাধারণত তিন মাস বয়সে মায়ের সঙ্গে একই বিছানায় শোয়ার পরিবর্তে আলাদা দোলনায় রাখা যেতে পারে। এই বয়সে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য স্বল্প সময়ের আলাদা ঘুম উপকারী। এরপর ৬-৭ মাস বয়সে শিশুকে ক্রিব বা ছোট বিছানায় শোয়ানো শুরু করা যায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ১ থেকে ৩ বছর বয়সের মধ্যে ধাপে ধাপে শিশুকে তার নিজস্ব ঘরে শোয়ানো শুরু করলে এটি স্বাভাবিক অভ্যাসে পরিণত হয়। শুরুতে কিছুটা অসুবিধা হলেও শিশুর জন্য এটি দীর্ঘমেয়াদি স্বাধীন ঘুমের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি।
২. ধীরে ধীরে অভ্যস্ত করা: শিশুকে হঠাৎ করে আলাদা ঘরে শোবার জন্য না পাঠানোই সবচেয়ে কার্যকর। প্রথমে শিশুকে তার বিছানায় বসিয়ে গান গাওয়া বা গল্প শোনানো যেতে পারে। এতে শিশুর মনে নিরাপত্তা ও আনন্দের অনুভূতি তৈরি হয়। এরপর শিশুকে ঘুমানোর পর তার পাশে থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে আসতে হবে। প্রথমে কম সময় পাশে থাকা, পরে পুরোপুরি বিছানা থেকে দূরে সরে আসা। ধাপে ধাপে অভ্যস্ত করলে শিশুর মধ্যে একা ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে ওঠে এবং তারা একা ঘুমকে স্বাভাবিক মনে করতে শুরু করে।
৩. শাস্তির পরিবর্তে পুরস্কার ব্যবহার: শিশুকে আলাদা ঘরে শোয়ানো কখনও শাস্তি হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়। এটি শিশুর কাছে নেতিবাচক অভিজ্ঞতা তৈরি করতে পারে। বরং শিশুকে বোঝাতে হবে যে, একা ঘুমানো তার জন্য একটি পুরস্কার। উদাহরণস্বরূপ, শিশুকে তার প্রিয় খেলনা, স্টিকার বা ছোট খাবার দিয়ে উৎসাহিত করা যেতে পারে। এটি শিশুকে প্রক্রিয়াটির সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে এবং তারা একা ঘুমকে একটি ইতিবাচক অভিজ্ঞতা হিসেবে গ্রহণ করে।
৪. নিরাপত্তা ও পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করা: শিশুর ঘর যেন সম্পূর্ণ নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ থাকে, তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঘরের তাপমাত্রা, আলো, বিছানা, বালিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা সঠিকভাবে রাখা জরুরি। শিশুর কাছে বেবি মনিটর বা সিসি ক্যামেরা ব্যবহার করলে তারা একা ঘুমালেও অভিভাবক শিশুর পরিস্থিতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। এটি শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং অভিভাবকের মনও শান্ত রাখে।
৫. অসুস্থ বা ভয় পেলে পাশে থাকা: যদি শিশু অসুস্থ থাকে বা একা ঘুমাতে ভয় পায়, সেক্ষেত্রে তাকে সম্পূর্ণ আলাদা না রেখে মায়ের বা বাবার পাশে একটি আলাদা শোয়ার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। এতে শিশু নিরাপদ বোধ করে এবং মাও নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। ধীরে ধীরে শিশুকে স্বাভাবিকভাবে আলাদা ঘরে শোয়াতে শেখানো যেতে পারে, যখন সে পূর্ণ স্বাস্থ্যবান ও নিরাপদ বোধ করবে।
শিশুরা ছোটবেলা থেকেই তাদের চারপাশ থেকে শেখা অভ্যাস দ্রুত আয়ত্ত করতে পারে। তাই ধীরে ধীরে এবং সচেতনভাবে শিশুকে আলাদা ঘরে শোয়ানোর অভ্যাসে অভ্যস্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি তাদের স্বাধীনতা, আত্মনির্ভরতা এবং আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে সহায়তা করে।
৬. রুটিন ও ঘুমের সময় নির্ধারণ: শিশুকে আলাদা ঘরে শোয়ানোর অভ্যাস গড়ার জন্য প্রতিদিন একটি নিয়মিত রুটিন তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুকে প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত করা হলে তারা ধীরে ধীরে একা ঘুমের জন্য মানিয়ে নেয়। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিদিন একই সময়ে স্নান, রাতের খাবার, গল্প বা গান—এই সব ধাপের মাধ্যমে শিশুকে শিথিল ও শান্ত করা যেতে পারে। রুটিন অনুসরণ করলে শিশু জানবে কখন ঘুমের সময় এসেছে এবং এটি তার জন্য স্বাভাবিক অভ্যাসে পরিণত হবে। রুটিনের মাধ্যমে শিশুর ঘুমের মানও উন্নত হয় এবং তারা নিরাপদ ও আরামদায়ক ঘুম পায়।