জার্মানির পরবর্তী চ্যান্সেলর (প্রধানমন্ত্রী) ফ্রিড্রিখ মের্টজ বলেছেন, ইউরোপের নিজস্ব প্রতিরক্ষা সক্ষমতা গড়ে তোলার প্রয়োজন হতে পারে, কারণ যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের নিরাপত্তা বিষয়ে আগের মতো মনোযোগী নেই। মের্টজের ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন দল সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়লাভ করেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইউরোপের সম্ভাব্য নতুন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হবে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াই ইতোমধ্যে চতুর্থ বছরে প্রবেশ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যের গুরুত্ব-
এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল সামরিক সহায়তার কারণেই ইউক্রেন নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেনকে ব্যাপক অস্ত্র সহায়তা দিয়েছিলেন। তবে নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিনি যুদ্ধ বন্ধ করতে চান এবং যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয়ের বিনিময়ে ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের ওপর অধিকার দাবি করেছেন।
কিয়েভ-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা থার্ড সেক্টর অ্যানালিটিকাল সেন্টারের পরিচালক অ্যান্দ্রি যলোতারেভ বলেন, ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা অপরিহার্য। তিনি উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিশাল অস্ত্রের মজুদ রয়েছে, যা ইউরোপের নেই।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের স্যাটেলাইট নজরদারি, গোয়েন্দা তথ্য এবং অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম ইউক্রেনের জন্য অনন্য এবং অপরিহার্য। পেট্রিওট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, এটিএসিএমএস দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, হিমারস রকেট সিস্টেম এবং সাঁজোয়া যানসহ বহু সরঞ্জাম শুধু যুক্তরাষ্ট্রই সরবরাহ করতে সক্ষম।
ইউরোপের সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনা-
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউরোপ উন্নত সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন করলেও, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধ হলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য মিলে সেই ঘাটতি কেবল আংশিকভাবে পূরণ করতে পারবে। সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে ইউরোপের বর্তমান পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নয়।
স্বেচ্ছা-নির্বাসিত রুশ মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী মার্ক ফেইগিন বলেন, ব্রিটেন ও ফ্রান্স পরমাণু শক্তিধর দেশ এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর সম্মিলিত অর্থনৈতিক সক্ষমতা রাশিয়ার চেয়ে বহুগুণ বেশি। তবে, ইউরোপ একটি একক রাষ্ট্র নয়, যা তাদের সামরিক সক্ষমতার কার্যকারিতা ব্যাহত করছে।
পুনর্নির্মাণের অর্থায়ন ও রুশ সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণ বিতর্ক-
যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্নির্মাণের জন্য ইউক্রেনকে বিশাল বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে, যা ৫০০ বিলিয়ন ডলার থেকে ২ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের ফলে এই ব্যয় আরও বাড়বে এবং মূল প্রশ্ন থেকে যাবে- এই ব্যয় বহন করবে কে?
একটি সম্ভাব্য উৎস হতে পারে পশ্চিমা দেশগুলোতে জব্দ করা রাশিয়ার সম্পদ, যেখানে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণ মজুদ রয়েছে। তবে, এই সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হলে আন্তর্জাতিক আইনি জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
বারনার্ড কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক অ্যালেক্সান্ডার কুলি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর সরকার এখনো রাশিয়ার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার বিষয়ে একমত হতে পারেনি। ট্রাম্প প্রশাসন এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করতে পারে, বিশেষ করে যখন তারা রাশিয়ার সঙ্গে সংঘাত নিরসনের চেষ্টা করছে।
নিউইয়র্কভিত্তিক রাজনৈতিক ঝুঁকি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইউরেশিয়া গ্রুপের সভাপতি ক্লিফ কুপচানও মনে করেন, ইউরোপীয় দেশগুলো রুশ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার পক্ষে অবস্থান নেবে না।
ইউরোপের বিনিয়োগ ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা-
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে ইউরোপীয় দেশগুলোর বিনিয়োগ ইউক্রেনের পুনর্নির্মাণে আসতে পারে। এক্ষেত্রে পশ্চিমা শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে।
যদিও ইউরোপ সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে ইউক্রেনকে সাহায্য করতে পারে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প হিসেবে সম্পূর্ণভাবে কার্যকর হতে পারবে কি না, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।