যেখানে বাংলাদেশের নারীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গবেষণা, প্রযুক্তি, এমনকি প্রতিরক্ষা খাতেও অদম্য গতিতে এগিয়ে চলেছেন, সেখানে রাজনীতির মঞ্চে তাঁদের পদচারণ এতটা দুর্লভ কেন? প্রশ্নটি সহজ হলেও এর উত্তর জটিল ও বহুস্তরবিশিষ্ট।
বাংলাদেশে একটি কথার প্রচলন আছে, ‘রাজনীতি মেয়েদের জন্য নয়।’ এটি নিছক কোনো আপ্তবাক্য নয়, বরং একটি প্রাতিষ্ঠানিক বাস্তবতা, যা বহু নারী প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায় টের পান। দেশের রাজনীতির পরিসর এখনো পরিবারকেন্দ্রিক ও পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত।
রাজনীতিতে সক্রিয় বেশির ভাগ নারী নেত্রীই কোনো প্রভাবশালী পুরুষ সদস্যের আত্মীয় বা রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন। সাধারণ নারীর জন্য এই অঙ্গনে প্রবেশের পথ প্রায় রুদ্ধই বলা চলে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ পরিবারে রাজনীতিকে নারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, অশোভন ও অগ্রহণযোগ্য পেশা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মেয়েদের বাইরে কাজ করার ক্ষেত্র এখনো সীমিত; সেখানে রাজনীতির মতো সংঘাতপূর্ণ অঙ্গনে প্রবেশকে পরিবার থেকে নিরুৎসাহিত করা হয়।
সহিংসতা, কালোটাকা, অস্ত্র, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও ভয়ভীতির বাস্তবতা, এসবই নারীদের জন্য অনিবার্য ঝুঁকি তৈরি করে এবং পারিবারিক অশান্তির কারণ হতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলো নারীর ক্ষমতায়নের কথা বললেও বাস্তবে অনেক সময়েই তাঁদের প্রতীকী ভূমিকায় আবদ্ধ রাখা হয়। কোনো মিছিল বা সমাবেশে নারী সদস্যদের সামনের সারিতে দাঁড় করানো হয় এই ধারণা থেকে যে, পুলিশ তাঁদের ওপর সহিংসতা চালাতে দ্বিধা করবে। কিন্তু নীতিনির্ধারণী বা কৌশলগত আলোচনায় তাঁদের উপস্থিতি প্রায় অনুপস্থিত।
রাজনীতি কেবল পুরুষের জন্য নয়; সমাজ পরিবর্তন, আইন প্রণয়ন ও দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তরে নারীর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব অপরিহার্য। নারী যদি পরিবার ও সমাজ গড়তে পারেন, তবে রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁর সমান অধিকার থাকা উচিত।
একই সমাজে যেখানে নারী ঘর সামলান, সন্তান লালন–পালন করেন এবং পরিবার গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন, সেই সমাজের রাজনৈতিক কাঠামোয় নারীর মতামত ও নেতৃত্বকে উপেক্ষা করা নিঃসন্দেহে পরিহাসজনক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যেটি দেশের রাজনীতির আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত, সেখানকার ছাত্রীদের মধ্যেই রাজনীতির প্রতি অনাগ্রহ স্পষ্ট। এর পেছনে রয়েছে ক্যাম্পাস সংস্কৃতি ও দৃষ্টিভঙ্গির সংকট। ‘রাজনীতি করা মেয়ে’কে আজও কটু দৃষ্টিতে দেখা হয়। তাঁকে বলা হয় ‘অত্যন্ত স্বাধীনচেতা’, ‘অভদ্র’ কিংবা ‘নিয়ন্ত্রণের বাইরে’। ছাত্ররাজনীতির সহিংস, পেশিশক্তি নির্ভর পরিবেশ মেয়েদের নেতৃত্বের পথ থেকে দূরে ঠেলে দেয়।
অনেক ছাত্রী মনে করেন, রাজনীতিতে এগোতে হলে কাউকে ‘আপু’ বা ‘ভাইয়া’ বলে প্রভাবশালী সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়; কিন্তু তাঁরা নিজেদের পরিচয়ে উঠে আসতে চান। নারীর রাজনীতিতে ব্যর্থতা খুব সহজেই গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়, অথচ সফলতা নিয়ে আলোচনা প্রায় হয়ই না। ‘রাজনীতিবিদ’ শব্দটি এখনো সমাজে পুরুষতান্ত্রিক ধারণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ফলে তরুণীদের মধ্যে রাজনীতিকে পেশা হিসেবে নেওয়ার আগ্রহ খুব কম।
রাজনীতি কেবল পুরুষের জন্য নয়; সমাজ পরিবর্তন, আইন প্রণয়ন ও দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তরে নারীর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব অপরিহার্য। নারী যদি পরিবার ও সমাজ গড়তে পারেন, তবে রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁর সমান অধিকার থাকা উচিত।
প্রয়োজন একটি নিরাপদ, স্বচ্ছ, সহনশীল ও অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ, যেখানে নারী কেবল অংশগ্রহণকারী নন, সিদ্ধান্তদাতার ভূমিকাতেও সমানভাবে অবদান রাখতে পারেন।
লেখা— নুসরাত রুষা, শিক্ষার্থী; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সূত্র: প্রথম আলো