৫ আগস্ট ছাত্র- শ্রমিক-জনতার আন্দোলনের মধ্যে পতিত আওয়ামীলীগ সরকার বারবার অভিযোগ করেছে-বাংলাদেশের পোলট্রি কোম্পানিগুলো নাকি ডিম আর মুরগির দাম বাড়িয়ে সিন্ডিকেট করছে। কিন্তু বাস্তবে আসলে কী ঘটেছিল?
প্রথমেই বলা যায়, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর আন্তর্জাতিক বাজারে মুরগির খাবারের (ফিড) মূল উপাদানগুলোর দাম হঠাৎ করে বেড়ে যায়। এটি দেশের কোনো খাতের নিয়ন্ত্রণে ছিল না-না পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রির, না সরকারের।
দ্বিতীয়ত: টাকার মূল্য কমে যায় ডলারের তুলনায়। ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১২০ টাকা লাগে ১ ডলার কিনতে। টাকার এই পতনের পেছনে ছিল পূর্ববর্তী সরকারের ভুল অর্থনৈতিক নীতিমালা। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি মাসে মান্থলি ইকোনমিক ট্রেন্ডস নামক প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে দেখা যায়-দেশে টাকার সরবরাহ বা মানি সাপ্লাই কীভাবে দ্রুতগতিতে বেড়েছে।
মানি সাপ্লাই বোঝাতে কয়েকটি পরিমাপক ব্যবহৃত হয়, এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এম২-মানে নগদ টাকা ও ব্যাংক জমা মিলিয়ে অর্থের মোট সরবরাহ।
২০২০ সালের জুন মাসে যেখানে এম২ ছিল ১৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন টাকা (লাখ কোটি), ২০২৩ সালের জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন টাকায়। অর্থাৎ মাত্র ৩ বছরে বাজারে অতিরিক্ত ৫ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন টাকা ঢুকে পড়ে-যা দিয়ে অন্তত ১৬টা পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব।
এই সময়ের মধ্যে সরকার ব্যাংকগুলোকে জোর করে কম সুদে ঋণ দিতে বাধ্য করেছিল, আবার একই সঙ্গে বাজেটে বিশাল ঘাটতি রেখেছিল-অর্থাৎ সরকারের ব্যয় কর আদায়ের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। যেকোনো অর্থনীতিবিদ বলবেন-কম সুদ এবং বাজেট ঘাটতির সমন্বয় মানেই বাজারে টাকার ঢল আর মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি।
যখন সরকার নিজেই বাজারে অতিরিক্ত টাকা ঢুকিয়ে মূল্যস্ফীতি ঘটায়, তখন একে প্রচলিত অর্থে বলা হয় “মানি প্রিন্টিং” বা কাগজে টাকা ছাপা।
কিন্তু সরকার স্বীকার করতে চায়নি যে মূল্যস্ফীতির জন্য তারা দায়ী। তাই তারা কল্পিত কিছু ‘সিন্ডিকেট’ বানিয়ে দোষ চাপাতে শুরু করে বেসরকারি খাতের ঘাড়ে।
কমপিটিশন কমিশন কয়েকটি পোলট্রি কোম্পানির বিরুদ্ধে মূল্য নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ তোলে, যেটি ছিল একেবারেই ভিত্তিহীন। মূলতঃ সরকার তখন জনগণের সামনে একটি স্কেপগোট বা বলির পাঁঠা খুঁজছিল।
বাংলাদেশে প্রতিদিন হাজার হাজার খামারি ডিম আর মুরগি বিক্রি করেন। এত বিক্রেতার বাজারে কেউ দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। অর্থনীতির পাঠ্যবই অনুসারে এটিই প্রতিযোগিতামূলক বাজারের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। এই বাজারে দাম ওঠানামা করে মৌসুমি চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে।
শীতে ডিমের চাহিদা কমে যায়, কারণ মানুষ শীতকালীন শাকসবজির দিকে ঝুঁকে পড়ে। আর গরমে মুরগি কম ডিম পাড়ে, ফলে সরবরাহ কমে গিয়ে দাম বেড়ে যায়। এই ওঠানামা পোলট্রি খাতের ‘সিন্ডিকেট’ নয়, বরং স্বাভাবিক কৃষিভিত্তিক মৌসুমি পরিবর্তন।
কমপিটিশন কমিশন চাইলে একজন অর্থনীতিবিদকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা করাতে পারত, সেটি না করে তারা তড়িঘড়ি করে দোষ চাপিয়ে দেয় এই খাতের উদ্যোক্তাদের ওপর।
মূল্যস্ফীতি রোধ করতে হলে আমাদের দরকার সঠিক অর্থনৈতিক নীতি। ব্যাংক ঋণের সুদহার উচ্চ রাখতে হবে, বাজেট ঘাটতি কমাতে হবে। নইলে টাকার মান আরও কমবে এবং মূল্যস্ফীতি বাড়তেই থাকবে।
ভবিষ্যতের কোনো সরকার যেন আর দায় চাপিয়ে না দেয় বেসরকারি কোম্পানিগুলোর ওপর। মূলাস্ফীতির জন্য কখনোই দায়ী থাকে না বেসরকারি খাত; এটি সর্বদা ঘটে সরকারের অদূরদর্শী অর্থনৈতিক নীতির কারণে।
- এই প্রতিবেদনটি ডিরেক্টর, কাজী ফার্মস এর লেখা থেকে প্রকাশ করা হয়েছে। সূত্র: ইত্তেফাক

