বিশেষ সাক্ষাৎকার: আবদুল মতিন কোয়ানি—
আফগানিস্তানের ইসলামিক আমিরাতের অভ্যন্তরীণ বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মুফতি আবদুল মতিন কোয়ানি। তাঁর কাবুল অফিসে বসে বহুভাষী এই শিক্ষাবিদ সূত্র সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন পাকিস্তানের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘাত শুরু হওয়ার পরে। পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাত ও সম্পর্ক, তালেবান সরকার ও তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) মধ্যে যোগাযোগ, ভারতের সঙ্গে তালেবান সরকারের কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন তিনি।
মুফতি কোয়ানি: ইসলামি আমিরাত সরকারের নির্দিষ্ট নীতি হলো শান্তির লক্ষ্যে কাজ করা। গত চার বছরে আফগানিস্তানের ভূমি ব্যবহার করে অন্য দেশের বিরুদ্ধে কিছু করা হয়েছে, এমন অভিযোগ কেউ করতে পারবেন না। দ্বিতীয় প্রধান নীতি হলো সব দেশের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রাখা। দেশ বলতে এখানে শুধু চীন বা রাশিয়ার কথা বলা হচ্ছে না। পাকিস্তানের সঙ্গেও দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রাখতেও আমরা আগ্রহী কারণ দুটি দেশই মুসলিম রাষ্ট্র। কিন্তু এমন কিছু শক্তি আছে, যারা একটা পরিস্থিতি তৈরি করে…যার ফলে সমস্যা বাড়ে…
মুফতি কোয়ানি: হ্যাঁ। এটা একটা দৈনন্দিন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে আর তারা কূটনৈতিক স্তরে এর সমাধানও চাইছে না। আমাদের একটা সময়ের পরে ভাবতে হয় যে কীভাবে আমরা আমাদের সার্বভৌমত্ব ও একতা বজায় রাখব। ফলে আমাদের পাল্টা হামলা চালাতে হয়, কারণ প্রথমে আমাদের ওপরে হামলা করা হয়েছিল। আমরাও সমুচিত জবাব দিয়েছি। তবে চাইব আলাপ এবং কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা মিটুক।
এটা লক্ষণীয় যে ভারত বা ইরানের সঙ্গে তাদের লড়াই থেমে যায়, কিন্তু আফগানিস্তানের সঙ্গে বছরের পর বছর চলতেই থাকে। কেন? এর উত্তর হলো পাকিস্তানে এমন কিছু গ্রুপ আছে, যারা বাইরে থেকে এজেন্ডা নিয়ে আসে এবং সেই বাইরের শক্তি লাভের জন্য কাজ করে। সেখানকার সাধারণ নেতৃত্ব বা মানুষ এটা করে না। এটা করে নির্দিষ্ট একটা গ্রুপ।
মুফতি কোয়ানি: এটা একটা প্রোপাগান্ডা, এর কোনো ভিত্তি নেই। আপনি আমায় বলুন যে ইসলামি আমিরাতের সরকার তো আজ থেকে চার বছর আগে ক্ষমতায় ছিল না, কিন্তু তখনো তাহলে কেন টিটিপি পাকিস্তানে সক্রিয় ছিল?
এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে পাকিস্তান ধারাবাহিকভাবে খাইবার পাখতুনের মতো এজেন্সি অঞ্চলে অপারেশন করে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের ওপরে অবিশ্বাস্য অত্যাচার করছে। মানুষকে যদি দিনের পর দিন বিচার না দেওয়া হয়, অত্যাচার করা হয়, তাহলে একটা সময়ের পরে তারা বিদ্রোহ করবে। এটা আমাদের বিষয় নয়, এটা তাদের বিষয়।
পাকিস্তানের নানা ধরনের সমস্যা আছে। আইনশৃঙ্খলার সমস্যা, বেলুচিস্তান বা পাঠানদের নিয়ে তাদের অঞ্চলে সমস্যা আছে। এগুলো না মিটিয়ে তারা নতুন ইস্যুর জন্ম দিচ্ছে মানুষকে ভুল বুঝিয়ে রাখতে। দ্বিতীয়ত, এটা লক্ষণীয় যে ভারত বা ইরানের সঙ্গে তাদের লড়াই থেমে যায়, কিন্তু আফগানিস্তানের সঙ্গে বছরের পর বছর চলতেই থাকে। কেন? এর উত্তর হলো পাকিস্তানে এমন কিছু গ্রুপ আছে, যারা বাইরে থেকে এজেন্ডা নিয়ে আসে এবং সেই বাইরের শক্তি লাভের জন্য কাজ করে। সেখানকার সাধারণ নেতৃত্ব বা মানুষ এটা করে না। এটা করে নির্দিষ্ট একটা গ্রুপ।

প্রশ্ন: তারা কারা?মুফতি কোয়ানি: আমি নাম নিতে পারব না।
মুফতি কোয়ানি: যে কেউই হতে পারে, আমেরিকা হতে পারে, ব্রিটেন হতে পারে। আমরা বলতে চাই যে আমরা শান্তি চাই এবং আমরা চাই যে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ুক। টিটিপির বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এর সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
মুফতি কোয়ানি: এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আমরা সবার সঙ্গে সম্পর্ক চাই। ২০ বছর ধরে আমেরিকা, ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমাদের শত্রু ছিল। কিন্তু তাদের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নত করতে আমরা আগ্রহী। আমরা তো রাশিয়ানদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি, কিন্তু আমাদের এখন একটা সম্পর্ক আছে। এমনকি ভারতের সঙ্গেও আমাদের অনেক মতবিরোধ আছে। কিন্তু আমরা তো লড়াই করি না। একজনের সঙ্গে সম্পর্কের জন্য অন্যের সঙ্গে লড়াই আমরা করব না। আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে লড়াই করব না ভারতের জন্য। আবার ভারতের সঙ্গে লড়াই করব না পাকিস্তানের জন্য।
মুফতি কোয়ানি: সেটা তাদের সমস্যা, আমাদের নয়। টিটিপি পাকিস্তানের বিষয়, আমাদের নয়।

মুফতি কোয়ানি: এই চিন্তার সঙ্গে আমরা একমত নই।
নানা ধরনের খনিজ পদার্থ এখানে আছে, যাতে এখনো হাত দেওয়া হয়নি। গোটা বিশ্বে এখন নানা ধরনের সমর অভিযান চলছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকা রাশিয়ার কাছাকাছি থাকতে চায়, রাশিয়াও এখানে থাকতে চায়। চীনারাও চায়। কিন্তু এরা সবাই জানে, শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তান বাইরের লোকদের মেনে নেবে না। ইতিহাস বলছে, এখানে অনেকেই এসেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউই থাকতে পারেননি।
মুফতি কোয়ানি: আল্লামা ইকবাল এক কবিতায় বলেছেন, আফগানিস্তান এশিয়ার হৃদয়। ভূকৌশলগতভাবে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দেশ। তা ছাড়া নানা ধরনের খনিজ পদার্থ এখানে আছে, যাতে এখনো হাত দেওয়া হয়নি। তৃতীয়ত, গোটা বিশ্বে এখন নানা ধরনের সমর অভিযান চলছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকা রাশিয়ার কাছাকাছি থাকতে চায়, রাশিয়াও এখানে থাকতে চায়। চীনারাও চায়। কিন্তু এরা সবাই জানে, শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তান বাইরের লোকদের মেনে নেবে না। ইতিহাস বলছে, এখানে অনেকেই এসেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউই থাকতে পারেননি।
মুফতি কোয়ানি: সঠিক কথা। এ বিষয়ে সম্পূর্ণ মতৈক্য আমাদের মধ্যে রয়েছে যে আফগানিস্তানের জমির এক ইঞ্চিও ছাড়া হবে না। আমরা সবার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক চাই, কিন্তু সব ধরনের আগ্রাসনের মোকাবিলা করা হবে।
মুফতি কোয়ানি: আমাদের সুনিশ্চিত করতে হবে আমরা একটা জাতিরাষ্ট্র হিসেবে অন্য দেশের ওপরে নির্ভরতা কমিয়ে যাতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি। সেভাবেই এই ইস্যুর সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
মুফতি কোয়ানি: আমাদের দেড় লাখের মতো তালেবান সৈন্য আছে। তারপর আফগান পুলিশ আছে আরও দুই লাখের মতো। এ ছাড়া রয়েছে গোয়েন্দা বাহিনী। সব মিলিয়ে চার থেকে সাড়ে চার লাখ সদস্য নিরাপত্তা বাহিনীতে আছেন।

মুফতি কোয়ানি: এটা একেবারেই ঠিক নয় যে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীতে অতীতের লোকজন নেই। যাঁরা মাঠপর্যায়ে কাজ করছিলেন বা যাঁদের অভিজ্ঞতা আছে, তাঁদের সরানো হয়নি। শৃঙ্খলার বিষয়ে আমি বলব যে এটা নিয়ে আমরা অনেক ভাবনাচিন্তা করেছি। পাঠ্যক্রম তৈরি করা হয়েছে, মুজাহিদ বাহিনীকে সেসব পড়ানো হয়েছে। এরপরই একটি শৃঙ্খলাপরায়ণ বাহিনী গত চার বছরে তৈরি হয়েছে।
মুফতি কোয়ানি: নিশ্চয়ই। গত এক বছরেই ১ লাখ ১০ হাজার নতুন ছেলেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। স্বল্প সময়ের কোর্স, দীর্ঘ সময়ের কোর্স থেকে ‘ব্রিজ কোর্স’ করানো হয়েছে। কীভাবে এই ব্যবস্থা কাজ করে, সেটা বোঝানো হয়েছে। এটা আফগানিস্তানের ভেতরে করা হয়েছে এবং দেশের বাইরেও করা হয়েছে।
মুফতি কোয়ানি: রাশিয়া, চীন…আমাদের মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিরাজউদ্দিন হাক্কানি স্পষ্টভাবে বলেছেন যে প্রত্যেককে ইসলামি আদর্শ এবং পুলিশের নিয়মনীতির সঙ্গে সংগতি রেখে কাজ করতে হবে। কোনো অভিযোগ এলে তার ফল ভালো হবে না।
মুফতি কোয়ানি: এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ তফাত। আমাদের এখন একটা শিক্ষিত বাহিনী রয়েছে।
মুফতি কোয়ানি: আমি আগেই বলেছি আমাদের উদ্দেশ্য আলোচনা ও কূটনীতির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা। সৌদি আরব এবং কাতারও সে রকমই মনে করে। কিন্তু পাকিস্তান কী ভাবছে, তা তো আমরা জানি না।
মুফতি কোয়ানি: কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি হবে।
মুফতি কোয়ানি: গত চার বছরে আমরা (দায়েশের) ঘাঁটি, কেন্দ্রগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে পেরেছি। এখন আর এমন কেউ নেই বলে আমরা মনে করি যারা আমাদের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। যদি কেউ কিছু আফগানিস্তানে করতে পারে, তবে তারা বাইরে থেকে তা করবে। কোনো ‘হোম গ্রোন’ বা দেশি সন্ত্রাসী এখানে কিছু করতে পারবে না। একজন আফগান, সে যে সম্প্রদায়েরই হোক না কেন, এখানে কোনো ঘটনা ঘটাচ্ছে না। অন্তত গত কয়েক বছরে আমরা সে রকমটাই দেখছি। যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলো সবই ঘটিয়েছে বাইরের লোক এবং দেশের বাইরে থেকে। দায়েশ যদি কিছু করে থাকে, তাহলে পাকিস্তান বা অন্য কোনো দেশে বসে তারা তা করছে। এখন নিশ্চিতভাবেই জানি যে পাকিস্তানের ভূমি এখানে পরিস্থিতি অশান্ত করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
মুফতি কোয়ানি: হ্যাঁ। আমরা পাকিস্তান সরকারের কাছে আবেদন করেছি, যাতে আফগানিস্তানবিরোধী শক্তিকে পাকিস্তানের ভূমি ব্যবহার করতে না দেওয়া হয়। তবে এখন পর্যন্ত তারা আমাদের কথায় কর্ণপাত করেনি।
- সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী: আপনাকে ধন্যবাদ।
- মুফতি কোয়ানি: আপনাকেও ধন্যবাদ।
সূত্র: সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর কলকাতা সংবাদদাতা- শুভজিৎ বাগচী।

