বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিএসইসি দীর্ঘদিন ধরে নিজস্ব জনবল দিয়ে পরিচালিত হয়ে আসছে। তবে সম্প্রতি মন্ত্রণালয় থেকে প্রেষণে কর্মকর্তা চেয়েছে কমিশন।
এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। বিএসইসির নিজস্ব কর্মকর্তারাও এতে অসন্তুষ্ট। পুঁজিবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করেন, বাইরের জনবল এলে বিএসইসির স্বকীয়তা নষ্ট হবে। এতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সংস্থাটির সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এমনকি বিশ্ব পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর জোট আইওএসকোর সদস্যপদ হারানোর আশঙ্কাও আছে।
স্বাধীনতা হারানোর শঙ্কা-
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছেন না। তিনি বলেন, “মন্ত্রণালয় থেকে কর্মকর্তা আনা হলে বিএসইসির স্বাধীনতা নষ্ট হবে। এটি আর স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে থাকতে পারবে না।”
তিনি আরও জানান, বিএসইসি নিজস্ব নিয়মকানুন প্রণয়ন করতে পারে। এটি একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা, যার ভূমিকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা দুর্নীতি দমন কমিশনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি কর্মকর্তাদের এখানে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হলে প্রতিষ্ঠানটির সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া প্রভাবিত হতে পারে।
প্রেষণে জনবল চাওয়ার কারণ-
৫ মার্চ বিএসইসির সাবেক নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমানকে অনিয়মের অভিযোগে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে কমিশনের কর্মকর্তারা চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের অবরুদ্ধ করেন।
পরে সেনাবাহিনী এসে তাঁদের উদ্ধার করে। পরদিন কর্মকর্তারা কর্মবিরতি পালন করেন। তাঁরা চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের পদত্যাগের দাবি তোলেন। এরপর বিএসইসির পক্ষ থেকে ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। তবে তারা জামিন পেয়ে কাজে ফিরে আসেন।
এই ঘটনার পর কমিশন নতুন জনবল চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে (এফআইডি) চিঠি পাঠায়। সেখানে ১৯ জন কর্মকর্তা চাওয়া হয়। এর মধ্যে ৩ জন নির্বাহী পরিচালক, ৩ জন পরিচালক, ১ জন কমিশন সচিব ও ১২ জন যুগ্ম বা অতিরিক্ত পরিচালক পদের জন্য অনুরোধ করা হয়।
বিএসইসির স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন-
মন্ত্রণালয়ের জনবল এলে বিএসইসির স্বকীয়তা নষ্ট হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক সাবেক পরিচালক বলেন, “বিএসইসিতে যা হচ্ছে, তা এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতো মনে হয় না। শেয়ারবাজারের সবাই জানে, এই কমিশনের ব্যর্থতা ও অযোগ্যতা কতটা ভয়াবহ। এই পরিস্থিতিতে যদি বাইরের জনবল নিয়ে আসা হয়, তাহলে শেয়ারবাজার আরও পিছিয়ে পড়বে।”
তিনি আরও বলেন, “স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিএসইসি কাজ করতে না পারলে আইওএসকোর সদস্যপদ হারানোর ঝুঁকি তৈরি হবে।”
পূর্বের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ শঙ্কা-
প্রতিষ্ঠার পর বিএসইসি প্রথমে মন্ত্রণালয়ের লোকবল দিয়ে পরিচালিত হতো। কিন্তু এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) সুপারিশে বিএসইসিতে নিজস্ব জনবল নিয়োগ শুরু হয়। ধীরে ধীরে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সরিয়ে নেওয়া হয়। ফলে এটি একটি স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে গড়ে ওঠে।
তবে দুই যুগ পর আবারও মন্ত্রণালয়ের জনবল নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে বিএসইসির স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, “পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো সাধারণত স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয়। কিন্তু যদি বিএসইসি নিজের স্বাধীনতা হারাতে চায়, তাহলে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা দরকার। সরকারেরও এটি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত।”
বিএসইসির এক কর্মকর্তা জানান, যদি নতুন কর্মকর্তারা মন্ত্রণালয় থেকে আসেন, তাহলে প্রতিষ্ঠানের ভেতরে বিভক্তি দেখা দিতে পারে। কারণ, তাঁরা অন্যদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেন।
বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ ও সংস্থার মুখপাত্র আবুল কালামের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে যোগাযোগ করা হলে কেউ ফোন ধরেননি।
বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করে। বিএসইসিও দীর্ঘদিন ধরে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে। তবে মন্ত্রণালয় থেকে জনবল এলে এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে পারে। এর ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিএসইসির গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

