২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দেশে পুঁজিবাজারে নেগেটিভ ইক্যুইটির বিপরীতে মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলোতে প্রভিশনিং ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৮৬২ কোটি টাকা। বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তথ্যমতে, মোট ১০ হাজার ৫২৫ কোটি টাকার নেগেটিভ ইক্যুইটির বিপরীতে প্রভিশন রাখা হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৭০১ কোটি টাকা। এই পরিস্থিতিতে বাজারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে এবং ঝুঁকি মোকাবিলায় দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর জোর দিচ্ছে সংস্থাটি।
২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর ছিল নেগেটিভ ইক্যুইটির বিপরীতে প্রভিশন রাখার জন্য নির্ধারিত সময়সীমা। যদিও ঐচ্ছিক ভিত্তিতে ধারাবাহিকভাবে এই সময়সীমা বৃদ্ধি পেয়েছে ২০১৬ সাল থেকে তবুও বেশিরভাগ ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংক উল্লেখযোগ্য হারে প্রভিশন করতে ব্যর্থ হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নয়ন না হওয়ায় এবার ২০৩০ সাল পর্যন্ত সময় বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্রোকারেজ হাউসগুলোর সংগঠন ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ)।
এই প্রেক্ষাপটে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের হস্তক্ষেপ চেয়ে চিঠি দিয়েছে বিএসইসি। চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১০ সালের পুঁজিবাজার ধস এবং পরবর্তী সময়ে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণে বিনিয়োগকারীদের মার্জিন অ্যাকাউন্টে অনাদায়কৃত ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় যা দীর্ঘ সময় ধরে নেগেটিভ ইক্যুইটি হিসেবে রয়ে গেছে। এই নেগেটিভ ইক্যুইটি অবলোপন না করা হলে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়বে।
কমিশনের মতে, এই সমস্যার সমাধানে একাধিক আর্থিক পদক্ষেপ গ্রহণ, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মার্জিন ঋণ বিধিমালার সংস্কার অত্যাবশ্যক। পূর্ববর্তী সময়ে নানা উদ্যোগ এবং ধারাবাহিক আলোচনা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না হওয়ায় এ পরিস্থিতি উদ্ভূত হয়েছে।
চিঠিতে আরো বলা হয়, চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত কমিশন বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অনাদায়কৃত ক্ষতির বিপরীতে প্রভিশন রাখার নির্দেশনা দিয়েছিল। কিন্তু সময়সীমা শেষ হলেও সমস্যার বাস্তব সমাধান হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে একটি উচ্চপর্যায়ের সভা ডাকার অনুরোধ করেছে বিএসইসি যাতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সহায়তা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের রূপরেখা নির্ধারণ করা যায়।
বিএসইসির একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ৩১ জানুয়ারির পর থেকে ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে তাদের অনাদায়কৃত ক্ষতির জন্য নতুন করে প্রভিশন রাখতে হবে। অনেক প্রতিষ্ঠান সময় বাড়ানোর অনুরোধ জানালেও কমিশন সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে মূলত টেকসই সমাধানের দিকেই জোর দিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, যদি এই সমস্যার কার্যকর সমাধান না হয় তবে ব্রোকারেজ হাউসগুলোর আর্থিক সক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং বিনিয়োগকারীদের ওপর নেগেটিভ ইক্যুইটির বোঝা ক্রমাগত বাড়তে থাকবে।
বিএসইসির তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যভুক্ত ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো ১.৭৪ লাখ মার্জিন বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের মোট ১৮ হাজার ১২৮ কোটি ৭০ লাখ টাকার মার্জিন ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে ডিএসইর সদস্যভুক্ত ব্রোকারেজ হাউস ১১ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা, মার্চেন্ট ব্যাংক ৬ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা এবং সিএসইর ব্রোকারেজ হাউস ৩৫ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে।
এই ঋণের বিপরীতে নেগেটিভ ইক্যুইটির মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রকৃত মার্জিন ইক্যুইটি ৭ হাজার ৮৬২ কোটি টাকা এবং সুদের পরিমাণ ২ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা।
ডিএসইর ব্রোকারেজ হাউসগুলোর মোট নেগেটিভ ইক্যুইটি ৬ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে মূলধন ঘাটতি ৫ হাজার ১৪৫ কোটি এবং সুদ ১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। এদের পক্ষ থেকে রাখা হয়েছে ১ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকার প্রভিশন। অপরদিকে, সিএসইর ব্রোকারেজ হাউসগুলোর নেগেটিভ ইক্যুইটি ৩০ কোটি টাকা, যার মধ্যে মূলধন ঘাটতি ৯ কোটি ও সুদ ২১ কোটি টাকা।
মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর অবস্থাও প্রায় একই। তারা মোট ৬ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকার মার্জিন ঋণ দিয়েছে যার বিপরীতে প্রকৃত নেগেটিভ ইক্যুইটি ২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা এবং সুদের পরিমাণ ১ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। এর বিপরীতে রাখা প্রভিশন মাত্র ১ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে, স্টক ব্রোকাররা পুঁজিবাজারে বিদ্যমান নেগেটিভ ইক্যুইটি এবং অনাদায়কৃত ক্ষতির বিপরীতে ধাপে ধাপে প্রভিশন রাখার সুযোগ চেয়ে ছয় বছরের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সময়সীমা নির্ধারণের প্রস্তাব দেয়। ডিবিএ কমিশনকে জানায়, ২০২৫ সালে ৫ শতাংশ, ২০২৬ সালে ১০ শতাংশ, ২০২৭ সালে ১৫ শতাংশ, ২০২৮ সালে ২০ শতাংশ, ২০২৯ সালে ২৫ শতাংশ এবং ২০৩০ সালে বাকি ২৫ শতাংশ প্রভিশন রাখার মাধ্যমে পুরো ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হবে।
এছাড়া নেগেটিভ ইক্যুইটি থাকা অ্যাকাউন্টগুলোতে নতুন করে মার্জিন ঋণ না দেওয়ার এবং এসব অ্যাকাউন্ট থেকে প্রাপ্ত সুদ কোম্পানির আয় হিসেবে না দেখানোর পরামর্শও দিয়েছে ডিবিএ। তারা আরো প্রস্তাব করেছে, মার্কিন মডেলে পরিচালকদের শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হোক যাতে ব্রোকারেজ হাউস বা মার্চেন্ট ব্যাংক মার্জিন কল শুরু হলে অনুমোদন ছাড়াই ঋণ বাতিল করতে পারে।
এই মুহূর্তে দেশের পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনঃস্থাপন করতে হলে নেগেটিভ ইক্যুইটি ইস্যুটি কার্যকরভাবে সমাধান করা অত্যন্ত জরুরি। আর সেই লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সমন্বিত ও দ্রুত পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।


