ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য মশিউর সিকিউরিটিজ (ট্রেক নম্বর ১৩৪)-এর বিরুদ্ধে দেশের পুঁজিবাজার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আর্থিক জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ও কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে প্রায় ১৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে। অভিযোগ অনুযায়ী, সমন্বিত গ্রাহক হিসাব (সিসিএ) থেকে ৬৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা এবং শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে আরও ৯২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা তুলে নেয় প্রতিষ্ঠানটি।
এ ঘটনায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে মশিউর সিকিউরিটিজের পরিচালনা পর্ষদ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে। একইসঙ্গে অভিযুক্তদের দেশত্যাগ ঠেকাতে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দিতে এবং তাদের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করতে ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে অবহিত করা হয়েছে।
বিএসইসি সূত্র জানায়, মশিউর সিকিউরিটিজের বিরুদ্ধে এই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে পূর্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, যেখানে ফৌজদারি অপরাধ ছাড়াও সিকিউরিটিজ আইনভিত্তিক সিভিল অপরাধের বিষয়ও উঠে এসেছে। ২০২৪ সালের ২০ আগস্ট ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিদর্শন দল প্রতিষ্ঠানটির সিসিএ তে ৬৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকার ঘাটতির তথ্য পায়। একইসঙ্গে বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবে থাকা শেয়ার বিক্রি করে ৯২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা সরিয়ে নেওয়ার প্রমাণও উঠে আসে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে ওই বছরের ২৮ আগস্ট কমিশনে জমা দেওয়া হয় পূর্ণাঙ্গ পরিদর্শন প্রতিবেদন।
পরবর্তীতে গত ২৯ আগস্ট বিএসইসি পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে, যার নেতৃত্বে ছিলেন উপপরিচালক মোহাম্মদ এমদাদুল হক। অন্যান্য সদস্যরা হলেন সহকারী পরিচালক মো. মারুফ হাসান, সহকারী পরিচালক অমিত কুমার সাহা, ডিএসই ম্যানেজার মোহাম্মদ ইকরাম হোসাইন এবং সিডিবিএলের ম্যানেজার শরীফ আলী ইরতেরাজ। কমিটি মশিউর সিকিউরিটিজের গ্রাহকদের হিসাব, ব্যাক অফিস সফটওয়্যার, ট্রেডিং ওয়ার্কস্টেশনের অনুমোদন, নেতিবাচক ইকুইটি, একই মোবাইল নম্বর বা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে একাধিক বিও খোলা হয়েছে কি না, এবং পরিচালনা পর্ষদ ও কর্মীদের নিজস্ব লেনদেন সম্পর্কেও তদন্ত করে।
বিএসইসি বলছে, আগের সরকারের সময় আইন লঙ্ঘনকারী ব্রোকারেজ হাউসগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বে পুনর্গঠিত কমিশন আইনভঙ্গকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় মশিউর সিকিউরিটিজের বিরুদ্ধে এই শাস্তিমূলক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পূর্ববর্তী কিছু আলোচিত জালিয়াতির উদাহরণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য, ২০২০ সালের ২৪ জুন ক্রেস্ট সিকিউরিটিজে ১২৪ কোটি টাকা, ২০২১ সালের ১৫ জুন বানকো সিকিউরিটিজে ১২৮ কোটি টাকা এবং ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর তামহা সিকিউরিটিজে ১৪০ কোটি টাকার সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে ঘাটতির প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে মশিউর সিকিউরিটিজের ১৬১ কোটি টাকার জালিয়াতি এসব ঘটনার মধ্যে সর্বোচ্চ।
এ বছরের ১০ এপ্রিল, রাজধানীর বিজয়নগরে ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্ট ফোরামের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতারিত বিনিয়োগকারীরা তাদের ক্ষতিপূরণ দাবিতে প্রধান উপদেষ্টা, অর্থ উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তারা প্রতারক পরিচালক ও কর্মকর্তাদের পাশাপাশি ডিএসই এবং বিএসইসির দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও শাস্তির দাবি জানান।
বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ অনুযায়ী, মশিউর সিকিউরিটিজ জালিয়াতির উদ্দেশ্যে অনুমোদনহীন ব্যাক অফিস সফটওয়্যার ব্যবহার করে বিনিয়োগকারীদের ই-মেইলে ভুয়া পোর্টফোলিও পাঠাতো, যা দেখতে মূল পোর্টফোলিওর অনুরূপ ছিল। এতে করে বিনিয়োগকারীরা বুঝতেই পারতেন না যে তাদের শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে। এছাড়া সিডিবিএলের কনফার্মেশন মেসেজ না পৌঁছানোর জন্য প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকের মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করে নিজেদের নম্বর বসিয়ে দিত। আরও একটি চাতুর্য ছিল, রেকর্ড ডেটের আগে উচ্চ দামে শেয়ার বিক্রি করে রেকর্ড ডেটের পর সেই পরিমাণ শেয়ার আবার কিনে রাখা, যাতে বিনিয়োগকারী বুঝতে না পারেন—তবে এভাবে তাদের লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত করা হতো এবং ক্রয়-বিক্রয়ের মূল্যের ব্যবধান আত্মসাত করা হতো।
মশিউর সিকিউরিটিজের বিরুদ্ধে এসব গুরুতর অনিয়ম ও প্রতারণার অভিযোগের ভিত্তিতে চলমান তদন্ত এবং আইনানুগ ব্যবস্থা দেশের পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় এমন জবাবদিহিতামূলক উদ্যোগ ভবিষ্যতে পুঁজিবাজারে অনিয়ম রোধে সহায়ক হবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

