চলমান দরপতনে বিপর্যস্ত দেশের পুঁজিবাজার ঘিরে কিছুটা আশার আলো দেখা গিয়েছিল গত রোববার। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পুঁজিবাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বৈঠক ডাকেন যা বিনিয়োগকারীদের মনে সাময়িক আশা জাগিয়েছিল। অনেকেই ভেবেছিলেন, এবার হয়তো স্থিতিশীলতার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ আসবে। কিন্তু বৈঠকের পর ঘোষিত নির্দেশনা বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। বরং তাদের মধ্যে হতাশা আরও গভীর হয়েছে।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার গত ৯ মাসে পুঁজিবাজারে স্থিতি ফেরাতে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখাতে পারেনি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বৈঠকের আয়োজন নিয়ে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল তা ম্লান হয়ে যায় বৈঠকের ধরন অংশগ্রহণকারীদের সীমাবদ্ধতা এবং ঘোষিত নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে। বিনিয়োগকারীদের মনে আস্থার সংকট আরও প্রকট হয়ে ওঠে যার সরাসরি প্রতিফলন দেখা গেছে গতকাল মঙ্গলবারের লেনদেনে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৪৬ দশমিক ৯৭ পয়েন্ট বা দশমিক ৯৫ শতাংশ কমে নেমে এসেছে ৪ হাজার ৮৭৪ পয়েন্টে। লেনদেন হয়েছে মাত্র সাড়ে তিনশ কোটি টাকারও কম। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) একই ধরনের পরিস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। সেখানে সার্বিক সূচক কমেছে প্রায় ৩৭ পয়েন্ট আর লেনদেন ছিল মাত্র সাত কোটি টাকার আশপাশে।
রোববারের বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে পাঁচ দফা নির্দেশনা আসে সরকারি কোম্পানি তালিকাভুক্ত করা, দেশি-বিদেশি বড় কোম্পানি বাজারে আনা, দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, ব্যাংকনির্ভরতা কমিয়ে বন্ডের মাধ্যমে অর্থ জোগাড় এবং বিদেশি বিশেষজ্ঞ এনে তিন মাসের মধ্যে সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করা।
তবে এসব সিদ্ধান্ত নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে প্রবল সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ সরাসরি এ নির্দেশনাগুলোকে “হাস্যকর” বলে মন্তব্য করেছেন। কারণ এই পাঁচ দফার প্রতিটিই পুরোনো এবং বহুবার আলোচিত হয়েছে। বিশেষ করে বিদেশি বিশেষজ্ঞ আনার বিষয়টিকে অনেকে অবাস্তব ও অযৌক্তিক বলে মনে করছেন। তাঁদের মতে, পুঁজিবাজারের বিদ্যমান সমস্যার সমাধান দেশের অভ্যন্তরেই খুঁজতে হবে। অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা ছাড়া কোনো টেকসই সংস্কার সম্ভব নয়।
একটি ব্রোকারেজ হাউজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “১৯৯৫ সালে আমরা আধুনিক স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। এখন কেন বিদেশি বিশেষজ্ঞ লাগবে? আমাদের কি মেধার অভাব?”
বিনিয়োগকারী, বাজার বিশ্লেষক এবং ব্রোকাররা বলছেন, পুঁজিবাজার সংস্কারে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ভুল পথে হাঁটছে। তাদের মতে, অংশীজনদের মতামত উপেক্ষা করে একতরফাভাবে সংস্কার পরিকল্পনা কার্যকর করার চেষ্টা করা হচ্ছে যার ফলে সংকট আরও বেড়েছে।
এক ব্রোকারেজ হাউজের শীর্ষ কর্মকর্তা অভিযোগ করে বলেন, “বিএসইসি চেয়ারম্যানের একতরফা চিন্তাধারায় সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে। এতে বাস্তব কোনো অগ্রগতি নেই শুধু সমস্যাই বাড়ছে। পুঁজিবাজারে ভয়াবহ অবস্থার পেছনে এটিই বড় কারণ।”
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মার্চেন্ট ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, “যে বৈঠক থেকে বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর বার্তা আসার কথা সেখানে হতাশাই মিলেছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরও দুর্বল হয়েছে। এর মানে বাজারের সামনে দীর্ঘমেয়াদি অন্ধকার সময় অপেক্ষা করছে।”
বিনিয়োগকারী সানী মাহমুদ বলেন, “গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর আমরা ভেবেছিলাম এবার হয়তো পুঁজিবাজার প্রভাবমুক্ত পরিবেশে ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু বিএসইসি এখনো রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে যেতে পারেনি। কমিশন নিজের ভেতরেই শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যর্থ। তাহলে বাজারকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে?”
পুঁজিবাজারের অংশীজনরা বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। তাদের মতে, চেয়ারম্যান ও তাঁর নেতৃত্বাধীন কমিশন বিনিয়োগকারী, বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং গণমাধ্যম সবার থেকেই দূরত্ব বজায় রাখছেন। এভাবে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়।
বিনিয়োগকারী মুক্তাদির আহমেদ বলেন, “আগে অন্তত লুটপাট হলেও জানতে পারতাম কী হচ্ছে। এখন অন্ধকারে থাকতে হয়। এই কমিশন যদি পদত্যাগ করে তবেই বাজারে আস্থা ফিরবে। কারণ তাঁরা পুঁজিবাজার বোঝেন না। ফলে ভালো কোম্পানিও আর বাজারে আসতে চায় না।”
সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের পুঁজিবাজার গভীর আস্থার সংকটে রয়েছে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরও কাঙ্ক্ষিত সংস্কার হয়নি। বরং পুরোনো ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটছে যা পুঁজিবাজারকে আরও দুর্বল করে তুলছে। অংশীজনদের মতামত উপেক্ষা করে এবং বিদেশি নির্ভরতার চিন্তা নিয়ে এগোলে বাজারে স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব নয় এটাই বিনিয়োগকারীদের সামগ্রিক মূল্যায়ন।

