বাংলাদেশের পুঁজিবাজার দীর্ঘদিন ধরেই একটি অনিয়ন্ত্রিত ও জটিল পরিবেশে চলছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তাঁর মতে, যাঁরাই অতীতে এই বাজার সংস্কারের দায়িত্ব নিয়েছেন, তাঁরাই কোনো না কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় তৎপর ছিলেন। এতে পুঁজিবাজার একটি নির্ভরযোগ্য অর্থনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠার পরিবর্তে ‘ডাকাতদের আড্ডায়’ পরিণত হয়েছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বারবার প্রতারণার শিকার হয়েছেন, হারিয়েছেন নিজেদের পুঁজি।
রোববার রাজধানীতে পুঁজিবাজারবিষয়ক সাংবাদিক সংগঠন ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্টস ফোরাম (সিএমজেএফ) আয়োজিত ‘সিএমজেএফ টক’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি গোলাম সামদানী ভূঁইয়া এবং সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আবু আলী।
প্রেস সচিব বলেন, পুঁজিবাজার সংস্কারে অতীতে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের কাজ ছিল গোষ্ঠীস্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া। এক গোষ্ঠীর সুবিধা রক্ষায় আরেক গোষ্ঠীকে দমন করা হয়েছে। ফলে বড় বিনিয়োগকারীরা সবসময় লাভবান হয়েছেন, কিন্তু ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হয়েছেন। তাঁরা বারবার শেয়ার কিনে সঞ্চয়ের চেষ্টা করলেও মূলত ‘ম্যানিপুলেশন’-এর শিকার হয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, কারসাজির প্রক্রিয়াটি দীর্ঘদিন ধরে ছন্দবদ্ধ এবং পরিকল্পিতভাবে পরিচালিত হয়েছে। এটি কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠী, যাঁরা ‘ভেস্টেড ইন্টারেস্ট গ্রুপ’ হিসেবে পরিচিত, তাঁদের মাধ্যমে সংগঠিত হয়েছে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়—এদের বিরুদ্ধে কি কখনো কোনো সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছে?
প্রধান উপদেষ্টার সাম্প্রতিক এক বৈঠকের প্রসঙ্গ টেনে শফিকুল আলম বলেন, ওই সভায় খুব জোরালোভাবে প্রশ্ন উঠেছে, কেন এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। তাঁর ভাষায়, “পুরো শেয়ার বাজারটা হয়ে গেছে ডাকাতদের আড্ডা। একজন ডাকাত গেলে আরেকজন ডাকাত এসে জায়গা নেয়।”
সংস্কারের জন্য যাঁদের আনা হচ্ছে, তাঁরাও দুর্নীতিগ্রস্ত বলে মন্তব্য করে শফিকুল আলম বলেন, “আপনি যাকে সংস্কারের দায়িত্ব দিচ্ছেন, সেও আরেকজন ‘ডাকাত’। এই জায়গায় সত্যিকারের সংস্কারের জন্য প্রয়োজন নিরপেক্ষ, গোষ্ঠীস্বার্থ থেকে অনেক দূরে থাকা লোকদের। প্রফেসর ইউনূসও বলেছেন, সংস্কার যেন নির্মমভাবে ও গভীরভাবে হয়।”
তিনি জানান, বৈঠকে প্রফেসর ইউনূস পুঁজিবাজার সংস্কারে আন্তর্জাতিক মানের একটি দল গঠনের ওপর জোর দিয়েছেন। এই বিদেশি বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে তিন মাসের মধ্যে সংস্কারের খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন এবং তার ভিত্তিতে দ্রুত বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে শফিকুল আলম বলেন, “তিন মাসের মধ্যে এই আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দল জানাবে কীভাবে বাংলাদেশের শেয়ার বাজারকে গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডে নিয়ে যাওয়া সম্ভব এবং সেই অনুযায়ী দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এতে বাজার আর কোনো গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। কেউ যেন এটিকে ব্যক্তিগত আয়ের উৎস বানাতে না পারে।”
তিনি আরও বলেন, “পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। অতীতে দেখা গেছে, প্রভাবশালী কিছু মানুষের আশপাশে থাকা লোকেরা রাতারাতি কোটিপতি হয়েছেন। এই অনিয়মের সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে।”
শফিকুল আলম বলেন, সরকার একটি বিস্তৃত অর্থনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরির চেষ্টা করছে, যাতে দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল এবং টেকসইভাবে এগিয়ে যেতে পারে। তাঁর মতে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটলে তার প্রভাব স্বাভাবিকভাবে পুঁজিবাজারে পড়বে।
ব্যাংকিং খাত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভূমিকম্পের মতো একদম বিপর্যস্ত ছিল। সেখান থেকে আমরা ব্যাংকিং খাতকে টেনে তুলে স্থিতিশীল করার চেষ্টা করছি।”
তিনি উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে মুদ্রাবিনিময় হার বাজারচালিত (ফ্লোট) করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন হয়নি। এটি সংস্কারের একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত বলে জানান তিনি।
চট্টগ্রাম বন্দরের সংস্কার নিয়েও প্রেস সচিব গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “আমরা চট্টগ্রাম বন্দর কাউকে হস্তান্তর করছি না। বরং বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে বন্দরের ব্যবস্থাপনা ও দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে তিন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে।” তাঁর মতে, বন্দরের দক্ষতা বাড়লে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বহুগুণ প্রভাব ফেলবে।
তিনি বলেন, “বর্তমানে বিশ্ববাণিজ্যে সুরক্ষাবাদ (প্রটেকশনিজম) প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এতে করে অনেক কম খরচের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নতুন গন্তব্য খুঁজছে, যেখানে কম শুল্ক ও কম শ্রমব্যয়ে উৎপাদন করা সম্ভব। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সবচেয়ে উপযুক্ত গন্তব্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।”
প্রেস সচিব জানান, প্রধানমন্ত্রী চান বাংলাদেশকে একটি উৎপাদনকেন্দ্র (ম্যানুফ্যাকচারিং হাব) হিসেবে গড়ে তুলতে। তবে এর জন্য বন্দরের দক্ষতা বাড়ানো জরুরি। তিনি বলেন, “আমাদের প্রয়োজন প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন। আমরা এই কারণে বিশ্বের বড় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলছি—দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ড, ডেনমার্কের এপি মোলার-মার্স্ক এবং সিঙ্গাপুরের পোর্ট অথরিটির সঙ্গে আলোচনা চলছে।”
এই কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো গেলে, বিশ্বমানের নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। এর প্রভাব পড়বে পুঁজিবাজারেও।
শেষে শফিকুল আলম বলেন, “আমরা যদি সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়াতে পারি এবং সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে পারি, তাহলে নিশ্চিতভাবেই এর ইতিবাচক প্রতিফলন পুঁজিবাজারে পড়বে। আমাদের ক্যাপিটাল মার্কেট তখন প্রবৃদ্ধির নতুন ধারা অর্জন করবে।”

