মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি নিয়ে সৃষ্টি হওয়া আইনি জটিলতা এবং হোয়াইট হাউসের আপিলের সিদ্ধান্তের ফলে ফের একবার অনিশ্চয়তায় পড়েছে এশিয়ার পুঁজিবাজার। এই অনিশ্চয়তার কারণে গতকাল অঞ্চলের বেশির ভাগ প্রধান সূচক ছিল নিম্নমুখী।
মার্কিন একটি আদালত গত সপ্তাহে ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে। প্রাথমিকভাবে এই রায়ের প্রেক্ষিতে আর্থিক বাজারে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং শেয়ারবাজার কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হয়। তবে হোয়াইট হাউস দ্রুত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে আদালত সেটিকে স্থগিত করে দেয়। ফলস্বরূপ বাজারে আবারও অনিশ্চয়তা ফিরে আসে এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় মার্কিন ফেডারেল সার্কিট আদালত গত বৃহস্পতিবার এক আদেশে জানিয়েছে, তারা সরকারের আপিল গ্রহণ করে ইউএস ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব ট্রেডের রায় স্থগিত রাখছেন। মামলার বাদী পক্ষকে ৫ জুন এবং ট্রাম্প প্রশাসনকে ৯ জুনের মধ্যে জবাব দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আদালতের এই রায়ের তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ে এশিয়ার বাজারে। জাপানের নিক্কেই ২২৫ সূচক দুপুর নাগাদ ১ দশমিক ১ শতাংশ হ্রাস পায়। একইসঙ্গে সরকারি তথ্য অনুসারে, চলতি মাসে টোকিওর কোর মূল্যস্ফীতি প্রত্যাশার চেয়ে বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই মূল্যস্ফীতির চাপ ব্যাংক অব জাপানকে সুদহার বাড়াতে বাধ্য করতে পারে, যা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
দক্ষিণ কোরিয়ার কসপি সূচকও বড় ধরনের পতনের মুখে পড়ে ৯ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। হংকংয়ের হ্যাংসেং সূচক কমে ১ দশমিক ৪ শতাংশ এবং সাংহাই কম্পোজিট সূচক দশমিক ৩ শতাংশের ঘাটতি দেখায়।
এদিকে, এর আগের দিন ওয়াল স্ট্রিটে সূচক ছিল ইতিবাচক। এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক বেড়েছিল দশমিক ৪ শতাংশ ডাও জোনস ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাভারেজ দশমিক ৩ এবং নাসডাক কম্পোজিট সূচক দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এই ঊর্ধ্বগতির পেছনে ছিল ট্রাম্পের শুল্কনীতিকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা সংক্রান্ত আদালতের রায় যা বাজারে আশাবাদ সৃষ্টি করেছিল। টোকিও ও সিউলে শেয়ারবাজারে ওইদিন লেনদেন শুরুর সময় সূচক প্রায় ২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়লেও দিন শেষে সেই ঊর্ধ্বগতি ধরে রাখা যায়নি।
ইউএস ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব ট্রেড আদালত জানায়, ট্রাম্প ১৯৭৭ সালের ইন্টারন্যাশনাল ইমার্জেন্সি ইকোনমিক পাওয়ার্স অ্যাক্টের (আইইইপিএ) এর আওতায় বৈশ্বিক আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করেছেন, যা আসলে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এমন ক্ষমতা দেয় না। আদালতের এই পর্যবেক্ষণ অনেক বিনিয়োগকারী ও সাধারণ নাগরিকের মধ্যে স্বস্তি জোগায় বিশেষ করে যারা বৈশ্বিক বাণিজ্য ক্ষতির মুখে এবং মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছেন।
তবে হোয়াইট হাউসের আপিলের কারণে আপাতত এসব শুল্ক বহাল থাকবে। আর সেই শুল্কগুলোর সবই এই রায়ে প্রভাবিত হবে না কারণ ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম ও গাড়ির মতো পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্ক এসেছে ভিন্ন আইনের আওতায়।
বাণিজ্য আদালতের বিচারকদের বক্তব্য অনুযায়ী, মার্কিন সংবিধান অনুসারে কর ও শুল্ক আরোপের অধিকার কংগ্রেসের প্রেসিডেন্টের নয়। ট্রাম্প এই সীমা ছাড়িয়ে জরুরি অবস্থা আইন ব্যবহার করে এসব শুল্ক আরোপ করেছেন। যদিও ট্রাম্প প্রশাসন আদালতের রায় নিয়ে উদ্বিগ্ন নয় বলে জানিয়েছে। তাদের মতে, তারা আপিলে জয়ী হবে এবং প্রয়োজনে অন্য প্রেসিডেন্সিয়াল ক্ষমতা প্রয়োগ করা হবে।
এক বিবৃতিতে বিচার বিভাগকে ‘অ্যান্টি-আমেরিকান’ বলে উল্লেখ করেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি আশা প্রকাশ করেন, সুপ্রিম কোর্ট এই ‘ভয়ানক’ এবং ‘দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ’ রায় পরিবর্তন করবে। তিনি বলেন, “রায়ে বলা হয়েছে শুল্ক আরোপের জন্য আমাকে কংগ্রেসের অনুমতি নিতে হবে। যদি এটা বহাল থাকে তাহলে প্রেসিডেন্সিয়াল ক্ষমতা ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রেসিডেন্সি আর আগের মতো থাকবে না।”
সার্কিট আদালতের আদেশে ট্রাম্পকে আপিল চলাকালে শুল্ক বহাল রাখার অস্থায়ী অনুমতি দেওয়া হয়। এই প্রসঙ্গে ইউবিএস গ্লোবাল ওয়েলথ ম্যানেজমেন্টের গ্লোবাল ইকুইটিজ বিভাগের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা উলরিকে হফম্যান-বুরচার্ডি বলেন, “ট্রাম্প এখনো অন্য আইনি উপায় ব্যবহার করে দীর্ঘমেয়াদে উল্লেখযোগ্য এবং বিস্তৃত শুল্ক আরোপ করতে পারেন।”
ওয়াল স্ট্রিটে বৃহস্পতিবারের সূচকের ঊর্ধ্বগতির পেছনে বড় অবদান ছিল প্রযুক্তি খাতের। বিশেষ করে চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এনভিডিয়া বিশ্লেষকদের প্রত্যাশা ছাড়িয়ে মুনাফা ও আয়ে চমক দেখায়। এর ফলে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ৩ দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি পায় যা এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকের বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশটির অর্থনীতি পূর্বাভাসের তুলনায় তুলনামূলক কম সংকুচিত হয়েছে। একই সময়ে বেকার ভাতার জন্য আবেদন করা কর্মীর সংখ্যা ছিল পূর্বাভাসের চেয়ে কিছুটা বেশি যার ফলে মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের ইল্ড কমে যায়।
শুল্কনীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মাঠে নামে লিবার্টি জাস্টিস সেন্টার যারা পাঁচটি ছোট ব্যবসার পক্ষে মামলা করে। সংস্থাটির দাবি, আদালতের অস্থায়ী স্থগিতাদেশ নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ মাত্র। তাদের আইনজীবী জেফ্রি শ্যাব বলেন, “এই ব্যবসাগুলো সরবরাহকারী হারানো, সরবরাহ চেইনে ব্যয়বহুল পরিবর্তন এবং টিকে থাকার হুমকির মধ্যে রয়েছে।”
এছাড়া আরেকটি আদালত ট্রাম্পের ১০ শতাংশ রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ এবং ২৫ শতাংশ ফেন্টানিল-সম্পর্কিত শুল্ককে আইনের অপব্যবহার বলে রায় দিয়েছে। তবে এই রায় কেবল একটি খেলনার কোম্পানির জন্য প্রযোজ্য।
সব মিলিয়ে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি ঘিরে আইনগত অনিশ্চয়তা এবং এর বিরূপ অর্থনৈতিক প্রভাব এখন শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, পুরো এশিয়ার শেয়ারবাজার ও বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় এক নতুন দ্বিধা ও উদ্বেগের সূচনা করেছে। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো আদালতের চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় থাকলেও বিনিয়োগকারীরা আপাতত রয়েছেন নড়বড়ে ভিত্তির ওপর।

