বিশ্বজুড়ে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ নিরাপদ হলেও বাংলাদেশে পরিস্থিতি ভিন্ন। এ খাতে বিনিয়োগ করলে মুনাফা কমে, অনেক সময় মূলধন ফেরত পাওয়া নিয়েও অনিশ্চয়তা থাকে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নতুন ‘মিউচুয়াল ফান্ড বিধিমালা-২০২৫’ প্রণয়ন করেছে।
নতুন বিধিমালা অনুযায়ী ভবিষ্যতে আর কোনো ক্লোজ এন্ড বা মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড অনুমোদন দেওয়া হবে না। এছাড়া বিদ্যমান মেয়াদি ফান্ডগুলো যদি বাজারদর ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেগুলোকে অবসায়নের পথে নিতে হবে। এর ফলে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৫ হাজার ৬৯০ কোটি টাকার মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের বাজার আর থাকবে না।
সম্পদ ব্যবস্থাপকদের অনিয়ম, টাকার নয়ছয় ও দুর্বল বিনিয়োগের কারণে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত মেয়াদি ফান্ডগুলোর প্রতি ইউনিটের দাম ফেসভ্যালুর নিচে অবস্থান করছে। বিনিয়োগকারীরা চাইলেও ন্যায্য দামে ইউনিট বিক্রি করতে পারছেন না। এতে তাদের ক্ষতি হচ্ছে এবং এ খাতে আস্থা কমছে। অন্যদিকে অমেয়াদি ফান্ডে বিনিয়োগকারীরা চাইলে ফান্ড ম্যানেজারের কাছে ইউনিট জমা বা সারেন্ডার করে টাকা তুলতে পারেন। শেয়ারবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সুপারিশের পর বিএসইসি নতুন বিধিমালা প্রণয়ন করেছে। বিধিমালার খসড়া ইতোমধ্যে বিএসইসির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে এবং ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত মতামত আহ্বান করা হয়েছে।
বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম বলেন, ‘নতুন বিধিমালার গেজেট হলে ভবিষ্যতে আর কোনো মেয়াদি ফান্ড অনুমোদিত হবে না। উন্নত দেশগুলো এ পথে যাচ্ছে, আমরাও সেগুলো অনুসরণ করছি। তবে যেসব ফান্ড ইতিমধ্যেই আছে, সেগুলো মেয়াদ পর্যন্ত থাকবে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এমন ব্যবস্থা আনছি যাতে ফান্ডগুলো নিট সম্পদ মূল্যের কাছাকাছি দরে লেনদেন হয়। তবুও যদি কোনো ফান্ড ব্যর্থ হয়, সেটি বেমেয়াদি ফান্ডে রূপান্তরিত হবে বা অবসায়ন করা হবে। নতুন আইনে ট্রাস্টি, কাস্টডিয়ান ও সম্পদ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে কেউ ফান্ডের অর্থ নিজেদের সম্পদ মনে করে ব্যবহার করতে না পারে।
শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মেয়াদি ফান্ড বন্ধ করলে বাজারে দীর্ঘমেয়াদি মূলধন প্রবাহ কমে যেতে পারে। এটি বাজারের স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকি তৈরি করবে। তাদের মতে, সমস্যার মূল কারণ ফান্ড ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা ও স্বচ্ছতার অভাব। কাঠামো বাতিল নয়, বরং সুশাসন ও তদারকি জোরদার করাই সমাধান।
নতুন খসড়া বিধিমালায় বিদ্যমান মেয়াদি স্কিমের জন্য রাখা হয়েছে বিশেষ বিধান। বিধিমালা গেজেট প্রকাশের ছয় মাসের মধ্যে কোনো ফান্ডের ইউনিটপ্রতি গড় লেনদেন মূল্য যদি নিট সম্পদ মূল্যের বা ক্রয়মূল্যের তুলনায় ২৫ শতাংশের বেশি কমে যায়, তাহলে ফান্ডের ট্রাস্টি বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) আহ্বান করতে পারবে। সেখানে তিন-চতুর্থাংশ ভোটে সিদ্ধান্ত হলে বিএসইসির অনুমোদন সাপেক্ষে ফান্ডটি বেমেয়াদি বা অবসায়ন করা যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন বলেন, ‘নতুন বিধিমালা বিনিয়োগকে সীমিত করছে কেবল ‘এ’ ক্যাটাগরির তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে। সম্পদ ব্যবস্থাপক ও ট্রাস্টিদের অর্থ স্থানান্তরের সুযোগ বন্ধ হচ্ছে। এসব পদক্ষেপ ফান্ড খাতকে ভবিষ্যতে আরও বিশ্বাসযোগ্য করবে।’
নতুন বিধিমালায় ফান্ডের বিনিয়োগ ক্ষেত্রও সীমিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ফান্ডের অর্থ কেবল স্টক এক্সচেঞ্জের মূল বোর্ডে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজ, আইপিও, রাইট শেয়ার ও সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করা যাবে। তালিকাভুক্ত নয় এমন, এসএমই বা এটিবি প্ল্যাটফর্মের শেয়ারে বিনিয়োগ নিষিদ্ধ থাকবে। কোনো সিকিউরিটিজ মূল বোর্ড থেকে বাদ পড়লে ছয় মাসের মধ্যে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে হবে।
গত এক দশকে মিউচুয়াল ফান্ড খাতের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা প্রায় হারিয়ে গেছে। ৫ হাজার ৬৯০ কোটি ২৮ লাখ টাকার তালিকাভুক্ত ৩৭টি মেয়াদি ফান্ডের মধ্যে মাত্র চারটির ইউনিট দর ১০ টাকার ওপরে। বাকি সব ফান্ড ৩ থেকে ৮ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। ২৭টি ফান্ডের রিজার্ভ ঘাটতি রয়েছে, যার পরিমাণ ৬৫৩ কোটি টাকার বেশি। সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে ঘাটতির পরিমাণ আরও বাড়ার শঙ্কা রয়েছে।
ফান্ডগুলোর মধ্যে ছয়টি দুই বছর ধরে আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে না। সর্বশেষ হিসাব বছরে আরও ১১টি ফান্ড অনিয়মিত হয়েছে। অর্থাৎ, সর্বশেষ হিসাব বছরে ২০টি ফান্ডের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র চারটি সামান্য মুনাফা করতে সক্ষম হয়েছে। বাকি ১৬টি লোকসান করেছে। শুধুমাত্র দুটির ইউনিটহোল্ডার সামান্য ক্যাশ ডিভিডেন্ড পেয়েছে, বাকি ১৮টি লভ্যাংশ-বঞ্চিত হয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেটের (বিআইসিএম) নির্বাহী প্রেসিডেন্ট ওয়াজিদ হাসান শাহ বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের আস্থা না থাকার ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে ফান্ডের ইউনিট দর এখন নিট সম্পদ মূল্যের অর্ধেকের নিচে। তবে মেয়াদি ফান্ড বন্ধ করাই সঠিক সমাধান নয়। ফান্ডের নিরাপদ বিনিয়োগের সুবিধা থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশে এক-তৃতীয়াংশ কম দামে বিক্রি হচ্ছে, কারণ সম্পদ ব্যবস্থাপকরা তহবিল তছরুপ করেছেন। এজন্য মেয়াদি ফান্ড একেবারে বন্ধ করা সমাধান হবে না।’