করোনা মহামারির দুঃসময়গুলো মনে পড়লেই আতঙ্কিত হয়ে উঠতে হয়। বিশেষ করে অক্সিজেন সংকটের খবরগুলো সবার কাছে ছিল একটি বিরাট উদ্বেগের বিষয়। ঠিক এমনই সংকটের মুহূর্তে উদ্ভাবনী একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন বগুড়ার প্রকৌশলী মো. মাহমুদুন্নবী বিপ্লব।
করোনা সংকটের সময় দেশীয় প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে মাত্র এক মাসের মধ্যে তিনি তৈরি করেন বহনযোগ্য অক্সিজেন কনসেনট্রেটর।
এই অক্সিজেন কনসেনট্রেটর দিয়ে ঘরের বাতাস থেকে প্রতি ঘণ্টায় ৩০০ লিটার বিশুদ্ধ অক্সিজেন উৎপাদন করা সম্ভব। যন্ত্রটির ব্যবহারও অত্যন্ত সহজ। একটি রেগুলেটরের মাধ্যমে মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে বিশুদ্ধ অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে।
৩০ কেজির কম ওজনের এই যন্ত্রটি হাসপাতালগুলোতে ব্যবহারের জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে এবং এটি মাত্র ৭০ হাজার টাকায় তৈরী করা সম্ভব। বর্তমানে এই কনসেনট্রেটরটি বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে (বিসিএসআইআর) গুণগত পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে এই যন্ত্রটি ব্যবহার করা যাবে।
মাহমুদুন্নবী যন্ত্রটির নাম দিয়েছেন ‘কে আর অক্সিজেন কনসেনট্রেটর’। এই যন্ত্রে প্রতি ঘণ্টায় ৬০০ লিটার অক্সিজেন উৎপাদনে বিদ্যুৎ খরচ হয় মাত্র ৩ টাকা।
গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের অক্সিজেন স্যাচুরেশন যদি ৯০ শতাংশের নিচে নেমে আসে, তখন অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। ৮০ শতাংশ স্যাচুরেশনেও এই যন্ত্রটি কার্যকরী।
দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের জন্য এটি একটি কার্যকরী বিকল্প হিসেবে প্রতিস্থাপন হতে পারে, যেখানে প্রতি বছর অনেক অক্সিজেন কনসেনট্রেটর বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়।
মাহমুদুন্নবীর উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা তাঁর শৈশব থেকেই শুরু হয়েছিল। স্কুল-কলেজে পড়াকালে বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে তাঁর আগ্রহ বাড়ে। মা-বাবার উৎসাহে ১৯৯৪ সালে তিনি বগুড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশনিং বিষয়ে ডিপ্লোমা করেন।
১৯৯৬ সালে শিক্ষকতা শুরু করার পর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন কাঁকন রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশনিং ওয়ার্কশপ। তিনি ভাগ্নে কাঁকনের নামে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করেন।
শুরুতেই তিনি উদ্ভাবন করেন বন্যা-পূর্ব সতর্কতার যন্ত্র, যা ব্যাটারি এবং সৌর প্যানেলেও কার্যকর। এই যন্ত্র ২০১৮ সালে বগুড়ায় ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলায় শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবকের পুরস্কার লাভ করে। তাঁর উদ্ভাবনগুলো সবার জন্য ব্যবহারের সুযোগ করে দিচ্ছে। মাহমুদুন্নবী বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ডিসি ভেন্টিলেশন সিস্টেমও তৈরি করেছেন, যা শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের একটি কার্যকরী বিকল্প।
মাহমুদুন্নবীর অন্যান্য উদ্ভাবনের মধ্যে রয়েছে বেবি ইউরিন অ্যালার্ম বেড, রোগীর শরীরে পুশ করার স্যালাইন অ্যালার্ম সিস্টেম, জলজ প্রাণীদের জন্য পানিতে অক্সিজেন সরবরাহের ওয়াটার অ্যারোয়েটর, করোনা প্রতিরোধে অটোমেটিক স্যানিটাইজিং মেশিন এবং ডিজিটাল ডোর লক।
বর্তমানে, তিনি গুরুতর অসুস্থ রোগীদের নিবিড় পরিচর্যা ওয়ার্ডে (আইসিইউ) ব্যবহারের জন্য ভেন্টিলেটর মেশিন প্রস্তুত করছেন। ধীরে ধীরে কাঁকন রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশনিং ওয়ার্কশপ উত্তরবঙ্গের অন্যতম বড় ওয়ার্কশপ হিসেবে গড়ে উঠছে।
তিনি আরো বলেন, “এখন উত্তরবঙ্গে অনেক বড় শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কারিগরি সমস্যা ও ত্রুটি মেরামতের জন্য বিদেশি প্রকৌশলীদের ওপর নির্ভরতা কমেছে।”
সচেতনতার পাশাপাশি প্রযুক্তি ও প্রকৌশল শিল্পের উন্নয়ন ঘটাতে তাঁর অবদান অপরিসীম। তিনি জানান, দুই দশকে তিনি যে শতাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, সেখান থেকে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী বর্তমানে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে প্রকৌশল খাতে কাজ করছেন। এই ধরনের উদ্ভাবন দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদী তিনি।