আধুনিক বিজ্ঞান মানবজাতিকে দিয়েছে এক যুগান্তকারী উপহার—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। চ্যাটজিপিটির মতো উন্নত প্রযুক্তি মুহূর্তে রচনা লিখে দিতে পারে, জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, আবার বিশাল তথ্যভাণ্ডার বিশ্লেষণ করে সমাধানও দেখাতে পারে। তাই বিশ্বজুড়ে এই প্রযুক্তিকে ঘিরে উচ্ছ্বাস ও বিস্ময় থামছেই না। অনেকেই ভাবছেন, হয়তো একদিন এটি মানুষের মস্তিষ্ককেও ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এআই কি সত্যিই মানব চিন্তার বিকল্প হতে পারবে?
এআই নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক সাফল্য। তথ্য বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে নির্দিষ্ট কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে এর দক্ষতা অসাধারণ। তবু মানুষের মস্তিষ্ক কেবল তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করে না—এতে থাকে সৃজনশীলতা, কৌতূহল, অনুভূতি ও নৈতিক বোধ। এই মানবিক গুণ কোনো যান্ত্রিক বুদ্ধিমত্তায় তৈরি হয় না।
শিক্ষা, গবেষণা ও উদ্ভাবনে এআইকে দেখা উচিত সহায়ক উপকরণ হিসেবে। এটি তথ্যসূত্র খুঁজে দিতে বা বিশ্লেষণ দ্রুত করতে পারে। কিন্তু নতুন তত্ত্ব দাঁড় করানো, গভীরভাবে অনুধাবন করা বা নৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজ মানুষের মস্তিষ্ক ছাড়া সম্ভব নয়। প্রকৃত উদ্ভাবন ও মৌলিক চিন্তার স্ফুরণ কেবল মানুষের মধ্যেই ঘটে।
উদ্বেগের বিষয় হলো—অনেক ক্ষেত্রে এআইকে এমনভাবে প্রচার করা হচ্ছে, যেন এটি মানুষের চিন্তা, পাঠচর্চা ও গভীর অধ্যয়নের বিকল্প হতে পারে। শিক্ষার্থীরা এতে অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়লে তাদের প্রশ্ন করার, বিশ্লেষণ করার ও নিজেরাই ভাবনার অভ্যাস কমে যায়। তারা পাঠ্যবই বুঝে পড়ার বদলে প্রস্তুত উত্তর গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। দীর্ঘমেয়াদে এটি তৈরি করবে এমন এক প্রজন্ম, যারা তথ্যগ্রহণে দক্ষ হলেও চিন্তাশীলতায় পিছিয়ে থাকবে।
পরীক্ষায় দ্রুত ভালো ফল পাওয়া গেলেও এই শর্টকাট পদ্ধতির ক্ষতি ভয়াবহ। শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু সনদ বা এ-প্লাস পাওয়া নয়—বরং জ্ঞানপিপাসু, সৃজনশীল ও নৈতিক মানুষ তৈরি করা। যদি শেখার মৌলিক অনুশীলন হারিয়ে যায়, তবে শিক্ষার্থীরা আপাতদৃষ্টিতে সফল হলেও ভেতরে শূন্যতা রয়ে যাবে।
সত্যিকারের জ্ঞান মানে মুখস্থ তথ্য নয়—এতে থাকতে হবে শেখার আনন্দ, অনুসন্ধিৎসা, সহমর্মিতা ও নতুন কিছু সৃষ্টির উদ্দীপনা। এসব গুণ যন্ত্র নয়, মানুষই গড়ে তুলতে পারে। শেখার প্রকৃত বিকাশের ক্ষেত্র মানব হৃদয় ও মস্তিষ্কেই।
মনে রাখা দরকার—এআই মানুষের সৃষ্টি। চ্যাটজিপিটির মতো প্রযুক্তির পেছনে রয়েছে মানুষের কল্পনা, গবেষণা ও শ্রম। তাই স্রষ্টার চেয়ে সৃষ্টির ক্ষমতা বড় হয়ে উঠতে পারে না। এআইয়ের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা বিশেষ করে কিশোর শিক্ষার্থীদের সক্রিয় চিন্তাশক্তি নষ্ট করতে পারে। সব উত্তর যদি সহজেই হাতে চলে আসে, প্রশ্ন করার ও গভীরে যাওয়ার প্রবণতা হারিয়ে যায়।
তাই প্রযুক্তি যেন থাকে শিক্ষার সহায়ক, প্রতিস্থাপক নয়। শিক্ষক, অভিভাবক ও নীতি-নির্ধারকদের দায়িত্ব—শর্টকাটের মোহে শিক্ষার্থীদের এমন পথে না ঠেলে দেওয়া, যা তাদের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা দেয়। আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের সমাজ-নির্মাতা। তাই তাদের সৃজনশীল চিন্তাকে বিকশিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব।
প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক, চিন্তার লাগাম মানুষের হাতেই থাকা উচিত। শিক্ষায় যদি শর্টকাট নির্ভরতা প্রজন্মের চিন্তাশক্তি নিস্তেজ করে দেয়, সেটি হবে সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থার জন্য এক ভয়াবহ বিপর্যয়।