মানবসভ্যতা বহুদিন ধরেই কাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছে। তবে আজকের মতো বাস্তব ও গভীর উদ্বেগ আগে দেখা যায়নি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও মেশিন লার্নিং এখন আর সায়েন্স ফিকশন নয়; এগুলো বিশ্ব অর্থনীতি, সমাজ ও কর্মসংস্থানের কাঠামো বদলে দিচ্ছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সর্বশেষ ফিউচার অব জবস রিপোর্ট ২০২৫ বলছে, আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৯২ মিলিয়ন চাকরি বিলুপ্ত হবে। একই সময়ে তৈরি হবে ১৭০ মিলিয়ন নতুন ধরনের পেশা। অর্থাৎ নিট হিসাবে যুক্ত হবে ৭৮ মিলিয়ন নতুন কর্মসংস্থান। এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যা নয় বরং পেশাগত রদবদলের স্পষ্ট ইঙ্গিত—যেখানে টিকে থাকার মূল চাবিকাঠি হবে অভিযোজন ও নতুন দক্ষতা অর্জন।
এই পরিবর্তনকে শুধু চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ধারাবাহিকতা ভাবলে ভুল হবে। আগের বিপ্লবগুলো মানুষকে শারীরিক শ্রম থেকে মুক্ত করেছিল কিন্তু এবার চ্যালেঞ্জ এসেছে মেধাভিত্তিক কাজের ওপর। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের চিন্তা, বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলছে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন, ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা ও জনসংখ্যাগত পরিবর্তনও এ রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করছে।
এআই মূলত প্রতিস্থাপন করছে পুনরাবৃত্তিমূলক ও নিয়মভিত্তিক কাজগুলো।
- অফিস ও প্রশাসনিক কাজ: ডেটা এন্ট্রি অপারেটর, ব্যাংক টেলার বা ক্লার্কের মতো পদ দ্রুত হারাচ্ছে প্রাসঙ্গিকতা। ওসিআর ও রোবোটিক অটোমেশন সফটওয়্যার এখন মুহূর্তে হাজারো ফাইল প্রক্রিয়াজাত করতে পারে।
- গ্রাহকসেবা: কল সেন্টারের বড় অংশ ইতিমধ্যে চ্যাটবট ও ভয়েস এআই দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। আধুনিক ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট এখন আবেগ বিশ্লেষণ করেও কথা বলতে সক্ষম।
- উৎপাদন খাত: কারখানার অ্যাসেম্বলি লাইন থেকে শুরু করে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট পর্যন্ত সব কিছু স্বয়ংক্রিয় হচ্ছে।
- ফাইন্যান্স ও হিসাবরক্ষণ: বুককিপিং, ইনভয়েসিং ও অডিটিং এখন এআই সহজেই করছে। এমনকি জালিয়াতি শনাক্ত করাও সম্ভব অ্যালগরিদমের মাধ্যমে।
- পরিবহন: চালকবিহীন যানবাহন এখনো পুরোপুরি বাস্তব না হলেও ভবিষ্যতে ট্রাক, ট্যাক্সি ও ডেলিভারি চালকের কাজ বড় ঝুঁকিতে থাকবে।
তবে এসব ক্ষেত্র থেকে মানুষের প্রয়োজন একেবারে ফুরিয়ে যাবে না; বরং কাজের ধরন বদলাবে। যেমন, গ্রাহকসেবায় আসবেন এআই ট্রেনার বা কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স স্ট্র্যাটেজিস্ট, যারা প্রযুক্তি উন্নত করে ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা বাড়াবেন।
মানবকেন্দ্রিক কৌশলের উত্থান
মার্সারের গ্লোবাল ট্যালেন্ট ট্রেন্ডস ২০২৪–২৫ রিপোর্ট জানায়, মানব সম্ভাবনাকেই এখন রূপান্তরের কেন্দ্রে রাখতে হবে। ৪১ শতাংশ নির্বাহীর মতে, দক্ষতার ঘাটতি ব্যবসা প্রবৃদ্ধির সবচেয়ে বড় বাধা। তাই ২০২৫ সালের লক্ষ্য হচ্ছে পিপল ম্যানেজারদের দক্ষতা বৃদ্ধি—বিশেষত সহানুভূতি ও নেতৃত্বে। প্রতিষ্ঠানগুলো বুঝতে পারছে, শুধু প্রযুক্তি নয়, কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও কাজের সন্তুষ্টিও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
এআই অর্থনীতিতে তৈরি হচ্ছে এক নতুন কর্মবিশ্ব। প্রযুক্তি, কৌশল ও মানবিকতার মেলবন্ধনে গড়ে উঠছে নতুন পেশা।
- প্রযুক্তিনির্ভর ভূমিকা: ডেটা সায়েন্টিস্ট, এআই স্পেশালিস্ট, ফিনটেক ইঞ্জিনিয়ার ও সাইবার সিকিউরিটি বিশ্লেষকের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে।
- পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন: নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকৌশলী, পরিবেশবিদ ও ইলেকট্রিক ভেহিকেল বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজন বাড়ছে।
- নৈতিকতা ও শাসন: এআই এথিসিস্ট, গভর্ন্যান্স স্পেশালিস্ট ও প্রম্পট ইঞ্জিনিয়াররা গড়ছেন ভারসাম্যের কাঠামো।
- মানব-যন্ত্র সমন্বয়: ভবিষ্যতে ‘হিউম্যান-মেশিন টিমিং ম্যানেজার’ হবেন মানুষ-যন্ত্র সহযোগিতার পরিচালক।
জাতিসংঘের জেন্ডার স্ন্যাপশট ২০২৫ রিপোর্ট জানায়, এআই যুগে নারী কর্মীরা পুরুষদের তুলনায় বেশি ঝুঁকিতে। বিশ্বজুড়ে ২৮ শতাংশ নারী কর্মসংস্থান হারানোর আশঙ্কায়, যেখানে পুরুষদের হার ২১ শতাংশ। কারণ, নারীরা বেশি নিয়োজিত প্রশাসনিক ও গ্রাহকসেবা পেশায়, যা সহজে অটোমেশনে প্রতিস্থাপনযোগ্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নারী কর্মীদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ ও STEM শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত না করা হলে এআই বিদ্যমান বৈষম্য আরও বাড়াবে। তাই এখনই দরকার যৌথ উদ্যোগ—ডিজিটাল প্রশিক্ষণ, দক্ষতা উন্নয়ন ও নীতিনির্ধারণে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো।
কিছু পেশা আছে, যেখানে যন্ত্র মানুষের বিকল্প হতে পারবে না।
- স্বাস্থ্যসেবা: সহানুভূতি ও নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে মানুষই শেষ ভরসা।
- শিক্ষা: শিক্ষক শুধু তথ্য দেন না, তিনি অনুপ্রেরণাও জোগান।
- সৃজনশীলতা: শিল্প, সাহিত্য ও কৌশল—যেখানে মানুষের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার বিকল্প নেই।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলছে, ভবিষ্যতের চাকরি নির্ভর করবে দক্ষতার ওপর, ডিগ্রির ওপর নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতাগুলোর মধ্যে রয়েছে বিশ্লেষণাত্মক ও সৃজনশীল চিন্তা, সহনশীলতা, দ্রুত মননশীলতা, কৌতূহল ও আজীবন শেখার অভ্যাস।
প্রযুক্তিগত সাক্ষরতা, এআই ও বিগ ডেটা জ্ঞান, নেটওয়ার্ক নিরাপত্তা এবং সামাজিক প্রভাবের ক্ষমতা হবে নেতৃত্বের নতুন মানদণ্ড।
এআই চাকরির শেষ নয় বরং নতুন সূচনা। রুটিন কাজের বোঝা যন্ত্র নেবে, আর মানুষ মনোযোগ দেবে সৃজনশীল ও কৌশলগত কাজে। টিকে থাকবে তারা, যারা পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে জানে।
তাই ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন তিনস্তরীয় প্রস্তুতি—ব্যক্তিকে হতে হবে আজীবন শিক্ষার্থী, প্রতিষ্ঠানকে মানবকেন্দ্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে, আর সরকারকে দিতে হবে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ ও সামাজিক সুরক্ষা।
প্রযুক্তি যেন মানবতাকে পেছনে না ফেলে বরং নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়—এই লক্ষ্যেই এগোতে হবে।

