নারীদের চলাচলে নিরাপত্তাহীনতা দীর্ঘদিনের সমস্যা। এর বাস্তব চিত্র আরো একবার স্পষ্ট হয় চলতি বছরের ৮ এপ্রিল। সেদিন রাতে স্লিপার কোচে ঢাকা থেকে সিলেটে ফেরার পথে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী বাসের ব্যবস্থাপকের দ্বারা শ্লীলতাহানির শিকার হন। শুধু এই ঘটনাই নয়—সিলেট শহরের বিভিন্ন এলাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশায় টিউশনি করতে যাওয়া অসংখ্য ছাত্রী প্রতিনিয়ত নানাভাবে হেনস্তার মুখোমুখি হন। কিন্তু এ সমস্যার কোনো কার্যকর সমাধান মিলছিল না।
এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে নারীদের একটি আধুনিক সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরির উদ্যোগ নেন কয়েকজন তরুণ শিক্ষার্থী। তাঁদের ভাবনা থেকে জন্ম নেয় ‘সলভওয়্যার’—একটি স্মার্ট নিরাপত্তা ডিভাইস, যা জরুরি মুহূর্তে ব্যবহারকারীকে তাৎক্ষণিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সক্ষম।
সলভওয়্যার উদ্ভাবনকারী দলের সদস্যরা হলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের রুহিতা রহমান, সমাজকর্ম বিভাগের নাজিফা নওয়ার, জৈবপ্রযুক্তি ও জিন প্রকৌশল বিভাগের ইউনুস কবির এবং লিডিং ইউনিভার্সিটির তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী মাজেদুল ইসলাম।
ডিভাইসটি তৈরির আগে তাঁরা তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০০ নারী শিক্ষার্থীর ওপর একটি বিস্তারিত জরিপ পরিচালনা করেন। উদ্দেশ্য ছিল—নারীরা কোন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে পড়েন এবং তাদের অভিজ্ঞতা কী বলে। জরিপের তথ্য সলভওয়্যারের নকশা ও ফিচার নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
জরিপের ফল অনুযায়ী, অংশগ্রহণকারী ৯০ শতাংশ নারী মনে করেন তাঁদের জন্য সহজে ব্যবহারযোগ্য আত্মরক্ষামূলক ডিভাইস জরুরি। নাজিফা নওয়ার জানালেন, ৮২ শতাংশ নারী কোনো না কোনো সময় যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন এবং ৬৮ শতাংশ নারী রাতে একা বের হতে ভয় পান। এ ছাড়া ৭৫ শতাংশ নারী মনে করেন সচেতনতামূলক প্রচারণা যথেষ্ট নয়, কার্যকর প্রযুক্তিগত সমাধান প্রয়োজন।
ডিভাইসটিতে রয়েছে ৪০০ কিলোভোল্ট ক্ষমতার একটি অ-প্রাণঘাতী ‘অ্যান্টি র্যাপ গ্লাভস’, যা বৈদ্যুতিক শক দিয়ে আক্রমণকারীকে সাময়িকভাবে নিরস্ত করতে সক্ষম। সক্রিয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্লাভসটি জিপিএসের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর অবস্থান নিরাপত্তা–সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেয়। একই সঙ্গে বাজে জোরালো অ্যালার্ম, যা আশপাশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাৎক্ষণিক সহযোগিতা চাইতে পারে।
ডিভাইসটির ব্যবহার নিয়ে দলের সদস্য মাজেদুল ইসলাম বলেন, ব্যবহারকারীকে ডিভাইসটি হাতে পরতে হবে। বিপদের সময় মাত্র এক ক্লিকেই হাই ভোল্টেজ শক, অ্যালার্ম এবং সতর্কবার্তা (এসওএস)—এই তিনটি ফিচার একসঙ্গে সক্রিয় হয়ে যাবে। এসওএস বার্তাটি জরুরি যোগাযোগ ও সংশ্লিষ্ট পুলিশ স্টেশনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পৌঁছে যায়।
দলের সদস্য রুহিতা রহমান জানান, জরিপে অংশ নেওয়া নারীদের ৭১ শতাংশ জরুরি অবস্থায় অ্যালার্ম ও এসওএস ফিচারকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখেছেন। ৬৫ শতাংশ নারী প্রাণঘাতী নয় এমন বৈদ্যুতিক শক ফিচারটির প্রতি ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। এ ছাড়া ৭৮ শতাংশ নারী চান ডিভাইসটি সাশ্রয়ী মূল্যে বাজারজাত হোক এবং ৫২ শতাংশ চান এটি মোবাইল অ্যাপের সঙ্গে সংযুক্ত থাকুক।
দলের আরেক সদস্য ইউনুস কবির বলেন, এটি শুধু একটি প্রযুক্তিগত সমাধান নয়—তাঁরা এমন একটি সমাজ গড়ার লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছেন, যেখানে প্রতিটি নারী তাঁর স্বপ্ন ও জীবনকে নিরাপদ পরিবেশে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। ভবিষ্যতে তাঁরা আরো বড় পরিসরে কাজটি এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন।

