নেপালের রাজপ্রাসাদ ‘সিংহদরবার’-এর লাইব্রেরিতে সম্প্রতি অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হয়েছে বহু শতাব্দীর পুরনো ইতিহাস, সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। ধারণা করা হচ্ছে, এই আগুন কোনো কিশোর গোষ্ঠী, আত্মপরিচয়বিহীন তথাকথিত “Generation Zombie” বা জেন জি-র বেপরোয়া কাজের ফল। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর আশঙ্কার কথা উঠেছে—এই আগুনে হয়তো হারিয়ে গেছে ‘বাংলা ভাষার আদিতম নিদর্শন’ “চর্যাপদ” -এর মূল পাণ্ডুলিপির অস্তিত্ব!
চর্যাপদের আদি নিবাস: নেপালই সাক্ষী
বিশ শতকের শুরুতে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তিনবার নেপাল ও তিব্বত ভ্রমণ করে সিংহদরবারের রাজপাঠাগারে খুঁজে পান “চর্যাচর্যবিনিশ্চয়”– এর পুঁথি। চর্যাপদ বাংলার আদিমতম কাব্য, যা প্রমাণ করে এই ভাষার শিকড় হাজার বছরের পুরনো। ধারণা করা হয়, জাতিগত সহিংসতা ও ধর্মীয় নিপীড়নের সময় এদেশের বিদ্বান, বৌদ্ধ সাধুরা এইসব রত্ন নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন হিমালয়ের পাদদেশে।
সেই থেকেই এই রত্নরাজি সিংহদরবারের সুরক্ষিত দেয়ালে ছিল যুগের পর যুগ। ‘অথচ আজ? হয়তো আগুনে ছাই হয়ে গেল কালের সঞ্চয়!’
লাইব্রেরি-মিউজিয়াম: যুদ্ধের প্রথম শিকার?
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—প্রথমে মরে বই, পরে মানুষ। আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার দগ্ধ হয়েছিল ৪৮ খ্রিস্টপূর্বে—সাথে শেষ হয়েছিল বিশ্বের প্রাচীনতম জ্ঞানভাণ্ডারের একটি। চেঙ্গিস খান ও হালাকু খানের সেনারা ধ্বংস করেছিল মধ্যপ্রাচ্যের বহু লাইব্রেরি—বিশেষত বাগদাদের ‘Bayt al-Hikma’। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনী পোল্যান্ডের জাতীয় লাইব্রেরি ধ্বংস করেছিল, সাড়ে তিন লাখ পাণ্ডুলিপি হারিয়ে গিয়েছিল চিরতরে।
তবুও কিছু রাষ্ট্র শিখেছে। নেপোলিয়ন যুদ্ধ করলেও শিল্পকর্ম ও লাইব্রেরি রক্ষায় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ব্রিটিশরা উপনিবেশ গড়লেও বই নষ্ট করেনি বরং নিয়ে গেছে, ক্যাটালগ করেছে, জাদুঘরে ঠাঁই দিয়েছে।
জেনারেশন জোম্বি কি তবে—নতুন হালাকু খান?
বর্তমান প্রজন্মের একাংশ, যাদের বলা হচ্ছে ‘জেনারেশন জি’ বা বিদ্রুপে ‘জেনারেশন জোম্বি’, তারা যেন কেবল চায় “ডিলিট- রিসেট” করে দিতে সবকিছু—ইতিহাস, সাহিত্য, মূল্যবোধ। তাদের দৃষ্টিতে লাইব্রেরি বোঝায় ধুলো জমে থাকা বইয়ের স্তূপ, আর ইতিহাস মানেই পুরনো মানুষের বকবকানি।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- ‘এই আগুনে কার লাভ, কার ক্ষতি?’
লাভবান কারা?
- যারা কট্টর মতাদর্শবাদীরা ইতিহাসের বিকল্প ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে সুবিধা পায়।
- যারা মনে করে তথ্য-মুক্ত পৃথিবীতে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়।
- সাংস্কৃতিক উপনিবেশ স্থাপন সহজ হয় যখন স্থানীয় ইতিহাস নাই হয়ে যায়।
- নিজেদের মনগড়া মতাদর্শ এবং একমুখী বিদ্যা গিলে খাইয়ে দেয়ার রাস্তা পরিস্কার রাখা।
- বিতর্কিত মনোভাব ধ্বংস করা।
- সৃষ্টিশীলতাকে বাধা দেয়া।
বিপরীতে ক্ষতি?
- ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ইতিহাসহীন হয়ে পড়ে।
- ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির শিকড় কেটে ছাটাই করা হয়।
- বৈচিত্র্য হারিয়ে একঘেয়ে বৈশ্বিক একরূপতা সৃষ্টি হয়।
- নতুনত্বের পদেপদে বিষাক্ত কাঁটা।
একটি সতর্কতা, একটি প্রতিজ্ঞা
একটি প্রজন্মের ভুলে যদি সহস্র বছরের ঐতিহ্য পুড়ে ছাই হয়, তবে দায় শুধু তাদের নয়—আমাদেরও। তথ্য ও প্রযুক্তির যুগে ইতিহাস রক্ষা করার দায় আমরা এড়াতে পারি না। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীরা যেমন খুঁজে এনেছিলেন চর্যাপদ, তেমনই আমাদের খুঁজে আনতে হবে ভবিষ্যতের চর্যাপদ—আবার, আবার, যতবার দরকার।
শেষ কথা: ইতিহাস যখন পুড়ে যায়, সভ্যতা পেছনে হটে
লাইব্রেরি, মিউজিয়াম, স্থাপত্য—এসবের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে জাতির পরিচয়, সত্ত্বা। হালাকু খানদের আগুনে কেবলই কাগজ পুড়ে যায় না, পুড়ে যায় আত্মপরিচয়ের শিকড়।
আমরা যদি এই আগুনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না পারি, তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম যখন জিজ্ঞাসা করবে—“আমাদের ইতিহাস কোথায়?”
তখন আমাদের কোনো উত্তর থাকবে না।
পৃথিবীর যেখানেই ইতিহাস, ঐতিহ্য, মিউজিয়াম, সাহিত্য ধ্বংসের খেলা চলে সেখানেই আমাদের আওয়াজ তুলে প্রতিবাদী ভূমিকায় দাঁড়াতে হবে। সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে প্রতিবাদ করতে হবে।
লেখক: মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম