আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় দেড় দশকের শাসনামলে দেশের পাঠ্যবইয়ে এক বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান পাঠ্যবইয়ে ব্যাপকভাবে উপস্থাপিত হলেও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে মেজর জিয়াউর রহমানের নাম বাদ যায়। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা রাখা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির অবদানও আস্তে আস্তে পাঠ্যবই থেকে অনুপস্থিত হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, তাজউদ্দিন আহমেদ এবং জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীর মতো নেতাদের অবদান সম্পর্কে ধীরে ধীরে কম জানছে।
এই প্রেক্ষাপটে, অন্তর্বর্তী সরকারের তত্ত্বাবধানে শিক্ষাক্রমে ইতিহাসের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার জন্য পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন এনে সেখানে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমানের নাম অন্তর্ভুক্ত করার কথা রয়েছে। এছাড়া ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারী’ প্রবন্ধে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নামও যুক্ত করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাকালে পাঠ্যপুস্তকে স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অবদান প্রধান্য পেয়ে আসছিল এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ভূমিকা অনেকটাই উপেক্ষিত ছিল। সংশোধনের পর, বঙ্গবন্ধুর অবদান সমুন্নত রাখার পাশাপাশি, স্বাধীনতার একক ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমানের নামও পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমানের দেওয়া স্বাধীনতার ঘোষণা ও তার পরদিন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাঁর আরেকটি ঘোষণার বিষয়টি ইতিহাসে যুক্ত করা হচ্ছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) জানিয়েছে, এই নতুন পাঠ্যসূচিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, তাজউদ্দিন আহমেদ, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীর মতো ব্যক্তিত্বদের অবদান তুলে ধরা হবে। সংশোধন কমিটির এক সদস্য জানান যে ইতিহাসকে কোনো পক্ষপাত ছাড়া উপস্থাপন করাই তাঁদের উদ্দেশ্য।
নতুন পাঠ্যবইয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রখ্যাত লেখক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালের রচিত ও সম্পাদিত বেশ কিছু প্রবন্ধ ও গল্প বাদ দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে এতদিন তাঁর লেখা সংযুক্ত থাকলেও এবার এনসিটিবি পাঠ্যসূচি থেকে সেগুলো সম্পূর্ণরূপে অপসারণ করছে। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘বায়ান্নের দিনগুলো’ শিরোনামের গল্পটিও বাদ দেওয়া হচ্ছে। এনসিটিবি এ বিষয়ে জানায়, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে আরও বাস্তবভিত্তিক উপস্থাপন করতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ইংরেজি বইয়ে রাখা হবে, যেখানে মার্টিন লুথার কিং এবং নেলসন মেন্ডেলার বিখ্যাত ভাষণও থাকবে।
এবার পাঠ্যপুস্তকে শেখ হাসিনা, শিরীন শারমিন চৌধুরীর পাশাপাশি খালেদা জিয়ার নাম অন্তর্ভুক্ত করে নারীর রাজনৈতিক অবদানকে তুলে ধরা হচ্ছে। শিক্ষাবিদদের মতে, এই পরিবর্তন শিক্ষার্থীদের সামনে দেশের ইতিহাসের সমন্বিত চিত্র তুলে ধরবে। অন্যদিকে, দীর্ঘদিন পাঠ্যবইয়ে শেখ হাসিনার ছবি ও বক্তব্য থাকলেও, নতুন সংস্করণে বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে গণআন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের আঁকা বিভিন্ন গ্রাফিতি যুক্ত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের বইয়ের পেছনে আরবি ক্যালিগ্রাফির গ্রাফিতি থাকবে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান জানিয়েছেন, পাঠ্যপুস্তক সংস্কারের এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হতে আরও দুই শিক্ষাবর্ষ সময় লাগবে। সংশোধন কমিটি ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে এবং নতুন পাঠ্যবই প্রকাশের উদ্যোগ নিতে তারা চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করছে বলে জানা যায়।