পঙ্গু হাসপাতাল ও চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আন্দোলনকারীরা বুধবার দুপুর থেকে হাসপাতালের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। তাঁরা জুলাই-আগস্টের সরকারবিরোধী আন্দোলনে আহত ব্যক্তিরা, যাঁদের কেউ হাঁটতে পারেন না, কেউ হুইলচেয়ারে, আবার কেউ চোখে আঘাতপ্রাপ্ত। দীর্ঘদিন ধরে সুষ্ঠু চিকিৎসা ও পুনর্বাসন না পাওয়ায় তাঁদের মধ্যে ক্ষোভ জমেছে, যা এ দিন প্রকাশ পায়।
এই আন্দোলনের প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে ছিল স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পদত্যাগ এবং আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের স্পষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ। তাঁরা এ দাবি আদায়ে উপদেষ্টাদের সেখানে উপস্থিত হওয়ার শর্ত দেন। প্রথমে চারজন উপদেষ্টাকে সেখানে আসতে বলেন এবং দাবি পূরণের আগে হাসপাতালের বিছানা-লেপ নিয়ে সড়কে অবস্থান চালিয়ে যান।
এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন পঙ্গু হাসপাতাল ও চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অর্ধশতাধিক আহত রোগী, যাঁরা জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় আহত হয়েছিলেন। তাঁদের দাবি আদায়ে সেখানে সেনা ও পুলিশের উপস্থিতি সত্ত্বেও তাঁরা নিজেদের অবস্থান বজায় রাখেন। আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন মো. মাসুম এবং আল মিরাজ, যাঁরা মিডিয়ার সামনে তাঁদের অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
আন্দোলনকারীদের শান্ত করতে গভীর রাতে সেখানে আসেন অন্তর্বর্তী সরকারের চারজন উপদেষ্টা এবং একজন স্বাস্থ্য সহকারী। উপস্থিত উপদেষ্টারা হলেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম এবং স্বাস্থ্য সহকারী ড. মো. সায়েদুর রহমান।
এই আন্দোলনের পেছনে প্রাথমিক কারণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য হলো আহত ব্যক্তিদের প্রতি সরকারের অসন্তোষজনক মনোভাব ও দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের সঠিক ব্যবস্থা না নেওয়া। এর আগে জুলাই-আগস্টে সরকারবিরোধী আন্দোলনে আহত ব্যক্তিরা ক্ষতিপূরণ ও সুষ্ঠু চিকিৎসা পাওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম এদিন তাঁদের দেখতে হাসপাতালে যান কিন্তু সবার সঙ্গে দেখা না করেই চলে যান। এতে আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। এ কারণে তাঁরা রাস্তায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভে শামিল হন।
মো. মাসুম নামের একজন আহত ব্যক্তির অভিযোগ, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা তিনতলায় গিয়ে তাঁর খোঁজ না নিয়ে চলে যান এবং তাঁদের অবহেলার মধ্যে ফেলেন। একইভাবে, চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের আল মিরাজ, যিনি গুলিতে চোখের আঘাত পেয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেন যে, তাঁর চিকিৎসা দেশের বাইরে প্রয়োজন, যা এখনো সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়নি।
ঘটনাটি ঘটেছে ঢাকার আগারগাঁওয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান এবং এর সামনের সড়কে। বুধবার দুপুর ১টা থেকে শুরু হয়ে রাত ২টা ৩০ মিনিটে উপদেষ্টারা পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত আন্দোলন চলে। রাত প্রায় সোয়া ৩টার দিকে উপদেষ্টাদের আশ্বাসে আন্দোলনকারীরা হাসপাতালের ভেতরে ফিরে যান।
রাত ১২টার পরেও উপদেষ্টারা না আসায় আহত ব্যক্তিরা হাসপাতালের বিছানা, লেপ এবং অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে রাস্তায় শুয়ে-বসে আন্দোলন চালিয়ে যান। উপদেষ্টাদের উপেক্ষা করা এই পরিস্থিতিকে আরও গুরুতর করে তোলে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাত আড়াইটায় উপদেষ্টারা সেখানে পৌঁছান এবং সরাসরি আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেন। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল তাঁদের দাবিগুলো শুনে সেগুলো বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতি দেন এবং দুঃখপ্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের ভুল আছে, তবে চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না।’
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার এবং স্বাস্থ্য সহকারী ড. মো. সায়েদুর রহমান আহতদের উন্নত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দেন। তাঁরা জানান, বৃহস্পতিবার দুপুর ২টায় সচিবালয়ে একটি বৈঠকে বসা হবে এবং আহতদের দাবির ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট একটি রূপরেখা তৈরি করে তা ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে।
উপদেষ্টাদের আশ্বাসে আন্দোলনকারীরা রাত সোয়া ৩টার দিকে সড়ক থেকে সরে যান এবং হাসপাতালের ভেতরে নিজেদের শয্যায় ফিরে যান। উপদেষ্টারা তাঁদের সাথে হাসপাতালে গিয়ে অবস্থানরত অন্যান্য রোগীদেরও খোঁজখবর নেন। রাত সাড়ে ৪টার দিকে উপদেষ্টারা হাসপাতাল ত্যাগ করেন।
এই আন্দোলন সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয় যে, আহত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন ও চিকিৎসা না হলে ভবিষ্যতে আরও কঠোর আন্দোলনের মুখোমুখি হতে হবে।