মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) বিকেলে ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রিতে সংবাদ সম্মেলনে কবর খনন বিশেষজ্ঞ বলেন- ছায়াঘেরা স্নিগ্ধ নৈসর্গিক পরিবেশ। কুমিল্লার ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি (যুদ্ধ সমাধি) থেকে ২৪ জন জাপানি সৈনিকের সমাধির মধ্যে ১২টি সমাধির খনন কাজ পূর্ণাঙ্গভাবে করা হয়েছে। আংশিকভাবে আরও ৫টি সমাধি খনন কাজ চলছে। এসব তথ্য জানিয়েছেন, জাপানের ফরেনসিক দলকে সহায়তাকারী মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্ণেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতীক।
৮১ বছর পরও সৈনিকদের শরীরের বিভিন্ন হাড় আমরা পাচ্ছি। এর কারণ হচ্ছে যেখানে সমাধিগুলো করা হয়েছে তা অপেক্ষাকৃত উঁচু ভূমিতে। কখনোই পানি আসেনি এখানে। অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে কিছুটা এক্সকাভেটর এবং বাকিটা ম্যানুয়ালি আমরা খননকাজ করছি। পুরো কাজ যথাসময়েই শেষ করার আশা করছি। ২৪ জনের মধ্যে ৩ জনের পরিচয় অজ্ঞাত। খনন করে সমাধি থেকে যতটুকু হাড় ও বিভিন্ন আলামত পাওয়া যাচ্ছে তা ডিএনএ প্রোফাইল হিসেবে অনেক সহায়ক হবে বলে জানান, সাজ্জাদ আলী।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন হতে দেখা যায়, কুমিল্লা ছিল সেনানিবাস। তখন বার্মায় ব্রিটিশদের সঙ্গে জাপানিজদের যুদ্ধ চলছিল। ব্রিটিশদের কমান্ডার ছিলেন ফিল্ড মার্শাল উইলিয়াম জোসেফ স্লিম। জাপানিজরা সিঙ্গাপুর দখল করার পাশাপাশি চীনের অনেক জায়গা দখল করে ভারতের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তখন ভারতকে ‘দ্য জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। জাপানিরা বার্মায় ঢুকে রাজধানী রেঙ্গুন (ইয়াঙ্গুন) দখল করে ফেলে। ওই সময় ব্রিটিশদের সঙ্গে জাপানিদের যুদ্ধ শুরু হয়। বার্মায় যুদ্ধে অনেক সৈনিক নিহত হন। ওই সময় কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি স্থানে যুদ্ধসমাধি তৈরি করেছিলেন ব্রিটিশরা। কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে উইলিয়াম স্লিম তাঁর সৈনিকদের প্রস্তুত করেন। তখন প্রতিপক্ষও ফেনীসহ বিভিন্ন এলাকায় বোমাবর্ষণ শুরু করে। একপর্যায়ে উইলিয়াম স্লিম একটা আন্ডারগ্রাউন্ড কমান্ডো ফোর্স গঠন করেন; কুমিল্লা সেনানিবাসে যা এখনো আছে পাশাপাশি ময়নামতিতে হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়। বার্মায় যুদ্ধে আহত ব্রিটিশসহ মিত্রদেশগুলোর সৈনিকদের বেশির ভাগকে চিকিৎসার জন্য ময়নামতি ও চট্টগ্রামে আনা হতো কিন্তু কুমিল্লায় কোনো যুদ্ধ হয়নি। তিনি বলেন, আহত জাপানিজ সৈনিকদের মধ্যে যাঁদের চিকিৎসার জন্য আনা হতো, তাঁদের সবাই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সৈনিকেরা যখন মারা যান, তখন স্লিম একটা যুদ্ধসমাধি তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। সমাধিস্থল নির্বাচনে করা কমিটির সদস্য ছিলেন তাঁর বাবা। তখন তাঁর বাবা স্লিমের সদর দপ্তরে ‘ডিফেন্স ইন্টারপ্রেটার’ হিসেবে কাজ করতেন।
ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রিতে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ১৩টি দেশের ৭৩৭ জন সৈনিককে সমাহিত করা হয়। এর মধ্যে মুসলিম ১৭২ জন, বৌদ্ধ ২৪, হিন্দু ২ ও বাকিরা খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী। তাঁদের মধ্যে যুক্তরাজ্যের ৩৫৭, কানাডার ১২, অস্ট্রেলিয়ার ১২, নিউজিল্যান্ডের ৪, অবিভক্ত ভারতের ১৭১, রোডেশিয়ার ৩, পূর্ব আফ্রিকার ৫৬, পশ্চিম আফ্রিকার ৮৬; বার্মা, বেলজিয়াম, দক্ষিণ আফ্রিকা ও পোল্যান্ডের ১ জন করে এবং জাপানের ২৪ জন নাগরিকের সমাধি আছে। ১৯৬২ সালে একজন সৈনিকের দেহাবশেষসহ সমাধির মাটি তাঁর স্বজনেরা যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গিয়েছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ফ্রান্সেস মাইকেল ও টিমের সমন্বয়ক সাদিক হোসেন রানা উপস্থিত ছিলেন। তবে খনন কাজ চলমান থাকায় নিরাপত্তার কারণে সাংবাদমাধ্যমকর্মীদের সেখানে প্রবেশের অনুমতি ছিল না।