বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএমইউ) হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন আহত ৪৬ জন জুলাই যোদ্ধা। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট ওই যোদ্ধাদের অনেকেই হাসপাতাল ছাড়ছেন না। তাঁদের দাবি, এখনও তাঁদের চিকিৎসার প্রয়োজন রয়েছে, অথচ জোর করে ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, তিন দিন আগে এসব আহতদের ছাড়পত্র দেওয়া হয়। কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা—বর্তমানে তাঁদের হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন নেই, নিয়মিত ফলোআপ চিকিৎসাই যথেষ্ট।
নিরাপত্তা জোরদার, তবে বাড়ছে অসন্তোষ
গত বৃহস্পতিবার কেবিন ব্লকের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় গিয়ে দেখা যায়, আনসার সদস্যদের দিয়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ। দায়িত্বরত এক আনসার সদস্য জানান, কেবল পরিচালক, চিকিৎসক ও নার্সরা ভেতরে প্রবেশ করতে পারছেন।
প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষার পর এক আহত ব্যক্তি বিছানাপত্র ও ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে আসেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই যোদ্ধা বলেন, “চোখ, মাথা ও বুকে শতাধিক ছররা গুলি এখনও শরীরে। এক চোখে দেখি না, ঘুমাতে পারি না। অথচ আমাকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।”
হাসপাতালের মূল ফটকের সামনে একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানান আরও পাঁচ-সাতজন আহত যোদ্ধা। তাঁদের একজন মো. সোহান, যিনি গত ৫ আগস্ট গাজীপুরের ভোগড়া বাইপাসে গুলিবিদ্ধ হন। বাঁ হাত ও পা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তিন মাস ধরে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।
সোহান বলেন, “চোখের হাসপাতালের ঘটনার পর হঠাৎ করে সবার ছাড়পত্র দেওয়া হলো। এটা অন্যায়। আমাদের এখনো চিকিৎসা প্রয়োজন।”
‘প্রয়োজন নেই হাসপাতালে থাকার’
এই বিষয়ে বিএসএমএমইউ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নোমান মোহাম্মদ মোছলেহ উদ্দিন বলেন, “মেডিক্যাল বোর্ড অনেক আগেই সুপারিশ করেছে, সবার হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন নেই। যাঁদের দরকার, তাঁরা থাকবেন। বাকিদের বলা হয়েছে, বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিতে। প্রয়োজনে অস্ত্রোপচার বা ফলোআপের জন্য ডাকা হবে।”
তাঁর মতে, ৫২ জন আহতের মধ্যে অল্প কয়েকজনের হাসপাতালে থাকা প্রয়োজন। বাকি ৪৬ জনের চিকিৎসা আপাতত সম্পন্ন।
কেবিন দখল নিয়ে বিতর্ক
হাসপাতালের কিছু চিকিৎসক ও কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, ছাড়পত্র পাওয়ার পরও অনেক আহত রোগী হাসপাতাল ছাড়ছেন না। ৬০টি কেবিনের সব কটিই তাঁদের দখলে। এতে সাধারণ রোগীদের ভর্তি করানো যাচ্ছে না।
তাঁদের দাবি, আহতরা অনেক সময় কর্মীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করছেন। কেবিনে কেরাম, লুডু খেলা, হইচই, এমনকি মারামারিও হয়। অনেকে স্ত্রীসহ থাকছেন কেবিনে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন আহত যোদ্ধা মো. সোহান। তিনি বলেন, “আমাদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অপবাদ দেওয়া হচ্ছে। কেবিনে সাধারণ রোগীও আছে, যাঁদের আমরা খাবার দিই। তবে নিরাপত্তার কারণে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে।”
‘আমরা অবহেলার শিকার’
আহত নাজমুল হোসেন জানান, গত তিন দিনে ১১ জন যোদ্ধা স্বেচ্ছায় হাসপাতাল ছেড়েছেন। তবে তিনি ও আরও অনেকে গুরুতর আহত থাকায় এখনো চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাঁর এক পায়ের গোড়ালি গুলিতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তিনি জানান, হাসপাতালে চিকিৎসার পাশাপাশি তিনি অনার্স তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছেন।
নাজমুল বলেন, “আমাদের শরীরে এখনও গুলি রয়ে গেছে। উন্নত চিকিৎসার আশায় এখানে এসেছিলাম, কিন্তু তা পাইনি। সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে আমাদের জন্য কেবিন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। পরে তা ডেঙ্গু রোগীদের জন্য ছেড়ে দিতে হয়।”
‘হাসপাতাল নয়, এটা যেন ক্লাব’
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বাস্থ্য) অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, “মেডিক্যাল বোর্ড বলেছে, তাঁদের হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু তাঁরা কেবিন ছাড়ছেন না। এটা এখন যেন ক্লাব বা যোগাযোগ কেন্দ্র হয়ে গেছে।”
তিনি আরও বলেন, “সরকার তাঁদের পুনর্বাসন ও চাকরির ব্যবস্থা করবে, তবে বাসস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। কেউ কেউ জানতে চান, কোথায় থাকব? এর জবাব হাসপাতালের পক্ষে দেওয়া সম্ভব না। ঢাকায় বাসস্থান দেওয়া অবাস্তব।”