সরকারি চাকরির কোটা বাতিলের দাবিতে গত বছর রাস্তায় নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা। সেই আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। এক পর্যায়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন ঘটে তৎকালীন সরকারের।
এই উত্তাল সময়ের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বিসিএস—বাংলাদেশের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত সরকারি চাকরির পরীক্ষা।
কিন্তু এবার ৪৪তম বিসিএস নিয়েই নতুন করে ক্ষোভ দানা বাঁধছে। চাকরিপ্রার্থীদের অভিযোগ, এই বিসিএসেও চলছে ‘বঞ্চনার রাজনীতি’।
শূন্য পদ আছে, কিন্তু নিয়োগ নয়
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি চাকরিতে অনুমোদিত পদ রয়েছে ১৯ লাখ ১৯ হাজার ১১১টি। কর্মরত আছেন ১৪ লাখ ৫০ হাজার ৮৯১ জন। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে চার লাখ পদ শূন্য—সংখ্যাটি ঠিক ৪ লাখ ৬৮ হাজার ২২০।
এর মধ্যে প্রথম থেকে নবম গ্রেড পর্যন্ত অনুমোদিত পদ রয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৬৫৭টি। কাজ করছেন ১ লাখ ৯০ হাজার ৭৭৩ জন। ফাঁকা রয়েছে ৬৮ হাজার ৮৮৪টি পদ।
তবুও ৪৪তম বিসিএসে অতিরিক্ত পদে নিয়োগের প্রস্তাব নাকচ হয়েছে।
আগের বিসিএসে পদ বাড়লেও এবার ব্যতিক্রম
পূর্ববর্তী বিসিএসগুলোতে নিয়মিতই পদের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছিল।
- ৩৮তম বিসিএসে পদ ছিল ২০২৪, সুপারিশ: ২২০৪
- ৪০তম বিসিএসে পদ ছিল ১৯০৩, সুপারিশ: ১৯৬৩
- ৪১তম বিসিএসে পদ ছিল ২১৬৬, সুপারিশ: ২৫২০
- ৪৩তম বিসিএসে পদ ছিল ১৮১৪, সুপারিশ: ২১৬৩
তবে এবার, ৪৪তম বিসিএসে ৪৩০টি অতিরিক্ত পদ বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হলেও সেটি অনুমোদন পায়নি।
কোন কোন ক্যাডারে প্রস্তাব ছিল?
প্রস্তাবিত ৪৩০টি অতিরিক্ত পদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল—
- বিসিএস সাধারণ শিক্ষা: ১৮৭
- স্বাস্থ্য (পরিবার ও পরিকল্পনা): ৫৪
- বিসিএস (কর): ৫৪
- বিসিএস (মৎস্য): ৩০
- বিসিএস (কৃষি): ৬৮
- রেলওয়ে ও সড়ক পরিবহন সংক্রান্ত ক্যাডারে বাকি পদ
এই প্রস্তাব ১৯ জুন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হয়। তবে তা বিবেচনায় নেয়নি কার্যালয়। ফলে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) কেবল পূর্বঘোষিত ১৭১০টি পদের ভিত্তিতেই ফল প্রকাশ করে।
পিএসসি বলছে, হাতে ছিল না অনুমোদিত পদ
পিএসসির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“আমরা কেবল অনুমোদিত পদের ভিত্তিতে ফল তৈরি করি। বাড়তি কোনো পদের অনুমোদন না আসায় সেটি যুক্ত করা সম্ভব হয়নি।”
তবে লিখিত ও মৌখিক উভয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও অনেকেই ক্যাডারে মনোনীত হননি।
পিএসসি জানায়, বিধি অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে তাঁদের নন-ক্যাডারে নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
পরিসংখ্যান বলছে, বঞ্চিত প্রায় ২৩০০ মেধাবী
- ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর ৪৪তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়।
- আবেদন করেন ৩ লাখ ৫০ হাজার প্রার্থী।
- প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হন ১৫ হাজার ৭০৮ জন।
- লিখিত পরীক্ষায় টিকে যান প্রায় ৪ হাজার।
- সেখানে থেকে ১ হাজার ৬৯০ জনকে সুপারিশ করা হয়।
- অর্থাৎ প্রায় ২ হাজার ৩০০ জন যোগ্য প্রার্থী বাদ পড়েন।
চাকরিপ্রার্থীদের ভাষ্য, “সবারই মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার যোগ্যতা ছিল, সবাই মেধাবীও। আগের রেওয়াজ অনুযায়ী পদ বাড়ানো হলে আমরা সুযোগ পেতাম। কিন্তু সেটা হলো না।”
রাস্তায় নেমেছেন চাকরিপ্রার্থীরা
ফল প্রকাশের দিন—সোমবার দুপুরে চাকরিপ্রার্থীরা রমনা পার্কের সামনে রাস্তা অবরোধের চেষ্টা করেন। তবে পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের সরিয়ে দেয়।
সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড়
সেদিনই জাতীয় নাগরিক কমিটির সাবেক সহমুখপাত্র মোহাম্মদ মিরাজ মিয়া তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে লিখেন,
“এই রাষ্ট্র প্রায় ১২ হাজার প্রার্থীর সঙ্গে প্রতারণা করতে যাচ্ছে।”
পোস্টটি শেয়ার করেন এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহসহ অনেকে।
সাবেক আমলাদের বক্তব্য: সরকারের সদিচ্ছার অভাব
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন,
“আগের বিসিএসে পদ বাড়ানো হলেও এবার দেখা যাচ্ছে—কোনো ইতিবাচক সাড়া নেই। এই সরকারের সদিচ্ছা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। যদি পদ খালি থাকে, যোগ্য প্রার্থী থাকে, তাহলে নিয়োগ বন্ধ কেন?”
তিনি আরও বলেন,
“এই বঞ্চনার দায় প্রধান উপদেষ্টাকেই নিতে হবে। কারণ, জনপ্রশাসন সচিবের প্রস্তাব থাকার পরও অনুমোদন দেননি তিনি।”
চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে তৈরি হওয়া সন্দেহ ও ক্ষোভ নিয়ে তিনি বলেন,
“সবার মধ্যে মনে হচ্ছে, সব কিছু আবার দলীয়করণ হতে চলেছে। মেধাবীদের জায়গা তৈরি না হলে এক সময় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে রাষ্ট্র।”