দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে (এনবিএফআই) ভয়াবহ লুটপাটের চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ব্যাংকের চেয়েও বেশি মাত্রায় খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকায় খাতটি এখন ধসের মুখে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) খেলাপি ঋণ বেড়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে ২৭ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের হার ৫০ থেকে ৯৯ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ এগুলো কার্যত দেউলিয়া হয়ে গেছে। গ্রাহকরা আমানত ফেরত পাচ্ছেন না, আবার নতুন ঋণ বিতরণও প্রায় বন্ধ। গত মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক ৯টি প্রতিষ্ঠানকে অবসায়নের (লিকুইডেশন) সিদ্ধান্ত নিলেও বাস্তবায়ন এখনও এগোয়নি।
আগে রাজনৈতিক প্রভাব আর পুনঃতফসিলের মাধ্যমে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র আড়াল করা হয়েছিল। তবে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারিতে লুকানো খেলাপি ঋণ বেরিয়ে আসছে। এর ফলে গ্রাহক আস্থা ভেঙে পড়ছে। অনেক আমানতকারী নিজের টাকা তুলতে পারছেন না। তথ্য বলছে, গত ৩০ জুন পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ঋণ স্থিতি ছিল ৭৭ হাজার ৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৭ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা খেলাপি, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২৫ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। সেই হিসেবে ছয় মাসে খেলাপি বেড়েছে ২ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা।
দেশে বর্তমানে ৩৫টি এনবিএফআই রয়েছে। এর মধ্যে ২২টি দেশীয় এবং ১৩টি যৌথ মালিকানাধীন। উচ্চ খেলাপি ঋণ ও আমানত ফেরত দিতে না পারায় বাংলাদেশ ব্যাংক গত মাসে ২০টি প্রতিষ্ঠানে নোটিশ পাঠায়। এর মধ্যে ৯টি প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনা সন্তোষজনক না হওয়ায় সেগুলো বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এগুলো হলো—এফএএস ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, আভিভা ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স ও প্রাইম ফাইন্যান্স। এসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৮০ থেকে ৯৯ শতাংশে পৌঁছেছে।
সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় থাকা আরও ১৩টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৫০ শতাংশের ওপরে। এর মধ্যে রয়েছে—সিভিসি ফাইন্যান্স, বে লিজিং, ইসলামিক ফাইন্যান্স, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স, হজ ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স, আইআইডিএফসি, উত্তরা ফাইন্যান্স, ফিনিক্স ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, ইউনিয়ন ক্যাপিটালসহ আরও কয়েকটি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্বল তদারকি এবং পরিকল্পিত লুটপাটের কারণে খাতটি আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। অনেক পরিচালক ও তাদের ঘনিষ্ঠরা ঋণের নামে বিপুল অর্থ তুলে নিয়েছেন। জরুরি সংস্কারমূলক পদক্ষেপ না নিলে শুধু আমানতকারীর অর্থ ফেরত পাওয়াই অনিশ্চিত নয়, গোটা আর্থিক খাত ধসে পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি সবার আগে দেখা হবে। সরকার থেকে অর্থ ছাড় হলে প্রক্রিয়া শুরু হবে। তবে যেকোনো পরিস্থিতিতে আমানতকারীদের টাকা রক্ষাই প্রধান অগ্রাধিকার।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, যে উদ্দেশ্যে এসব প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পেয়েছিল, তা পূরণ হয়নি। বরং অনিয়ম ও তছরুপের মাধ্যমে বিপুল অর্থ লোপাট হয়েছে। তাই দ্রুত এক্সিট পলিসির আওতায় এনে অনিয়মে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয়া উচিত।

