দেশের ব্যাংক খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রবণতা ২০১৫ সালের পর থেকে বেড়েছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যবসায়ী প্রভাব খাটিয়ে নিয়মকানুন না মেনে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়েছেন। এতে এসব ব্যাংক প্রতি বছরই লোকসানে পড়ে।
তবে আর্থিক বাস্তবতা আড়াল করতে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়েছে, যা ‘ডেফারেল’ নামে পরিচিত। এই সুবিধার মাধ্যমে ব্যাংকগুলো লোকসান গোপন করে কাগজে-কলমে মুনাফা দেখাতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ, ব্যাংকগুলো ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখার নিয়ম না মানেও শেয়ারহোল্ডারদের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। সম্পদের বিলম্বিত কর হিসেবেও তারা ডেফারেল সুবিধা নিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক এই বিশেষ সুবিধার মাধ্যমে ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি দায় নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর হিসাব বছরের শেষে মুনাফা ঘোষণার আগে তাদের প্রথমে প্রভিশন ঘাটতি ও অন্যান্য আর্থিক দায় মেটানো উচিত। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো এ নিয়ম মানেনি। বরং ৫ থেকে ১০ বছরের ডেফারেল সুবিধা নিয়ে প্রতি বছরই লাভ দেখিয়েছে। ফলে প্রভিশন ঘাটতি ও বিলম্বিত করের দায় জমতে জমতে এখন বিশাল অঙ্কে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের মোট ডেফারেল দায় দাঁড়িয়েছে ৮৯ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৮৬ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতির জন্য এবং ৩ হাজার ৩২১ কোটি টাকা সম্পদের বিলম্বিত করের জন্য নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, ব্যাংকগুলো বাস্তবে লোকসানে থাকলেও হিসাবের খাতায় নিজেদের মুনাফা দেখিয়েছে।
দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি ব্যাংক ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেফারেল সুবিধার মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের দায় নিয়েছে। তথ্য অনুযায়ী, এই সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে জনতা ব্যাংক লিমিটেড। এককভাবে এই ব্যাংক ৪৬ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকার বিশেষ সুবিধা নিয়েছে। এর মধ্যে ৪৬ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতিতে এবং ৬৭৮ কোটি টাকা সম্পদের বিলম্বিত করের বিপরীতে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মোট ডেফারেল সুবিধার প্রায় অর্ধেক নিয়েছে জনতা ব্যাংক একাই।
- দ্বিতীয় অবস্থানে আছে অগ্রণী ব্যাংক। ব্যাংকটি ১৭ হাজার কোটি টাকার ডেফারেল সুবিধা নিয়েছে। এর মধ্যে ১৫ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতিতে এবং ১ হাজার ৪৯ কোটি টাকা ডেফার্ড ট্যাক্স অ্যাসেটের বিপরীতে নেওয়া হয়েছে।
- তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে রূপালী ব্যাংক। এ ব্যাংক ১৩ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকার ডেফারেল সুবিধা নিয়েছে। এর মধ্যে ১৩ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতিতে এবং ৫৮ কোটি টাকা সম্পদের বিলম্বিত করের জন্য নেওয়া হয়েছে।
- চতুর্থ অবস্থানে আছে দেশের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালী ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটি ৬ হাজার ১৬৮ কোটি টাকার ডেফারেল সুবিধা নিয়েছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতিতে এবং ১ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা ডেফার্ড ট্যাক্স অ্যাসেটের জন্য নেওয়া হয়েছে।
গত এক দশকে ঋণ জালিয়াতির কারণে আলোচিত বেসিক ব্যাংক ৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকার বিশেষ সুবিধা নিয়েছে, যা পুরোপুরি প্রভিশন ঘাটতির বিপরীতে নেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে কম ডেফারেল সুবিধা নিয়েছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল), যা ১৫৫ কোটি টাকার বিশেষ সুবিধা নিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে এ ছয় ব্যাংকের মোট ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ ৩ লাখ ৭১ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ রয়েছে জনতা ব্যাংকে, যা ১ লাখ ১৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। দ্বিতীয় স্থানে আছে অগ্রণী ব্যাংক, ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকার ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ নিয়ে। সোনালী ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ ৭৯ হাজার ৫৭০ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ৫৬ হাজার ৩৪৬ কোটি, বেসিক ব্যাংকের ১৮ হাজার ৫৮৫ কোটি এবং বিডিবিএলের ৪ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। বিশাল এই ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আর্থিক অস্থিতিশীলতার প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ডেফারেল সুবিধা আসলে একটি ‘অর্থনৈতিক কসমেটিক’ ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যাংকগুলো প্রকৃত লোকসান আড়াল করে কাগুজে মুনাফা দেখাতে পারে। তবে বাস্তব সমস্যা থেকে যায়। মূলধন ঘাটতি, অনিয়মিত ঋণ অনুমোদন এবং প্রভাবশালী খেলাপিদের দায়মুক্তি—সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ-এর রিসার্চ ফেলো ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক এম হেলাল আহমেদ জনি জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই বিশেষ সুবিধা মূলত রাজনৈতিক চাপের ফল। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর লোকসান প্রকাশ করলে সরকারের আর্থিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই হিসাবগতভাবে লাভ দেখানোর জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি ব্যাংক খাতের জন্য বড় ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।
তিনি আরও বলেন, এখনই ডেফারেল সুবিধা বন্ধ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর প্রকৃত আর্থিক অবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি অদক্ষ পরিচালনা পর্ষদ ও রাজনৈতিক নিয়োগ বন্ধ করে পেশাদার ব্যাংকারদের নেতৃত্বে ব্যাংকগুলোকে পুনর্গঠন করা জরুরি। অন্যথায়, কয়েক বছরের মধ্যেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো কার্যত দেউলিয়া হয়ে পড়বে।

